উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক (প্রথম অধ্যায়: সনাতন মূল্যবোধ-২)

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০১৭, ০২:১৯

উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক, বিলকিস রহমান রচিত প্রথম গ্রন্থ, তার গবেষণার আলোকে লেখা। 

পড়ে শেষ করলাম বইটি, পড়তে যেয়ে একটু বেশি সময় নিয়েছি, নিতে হয়েছে। আমাকে ভাবিয়েছে বইটি, তথ্য উপাত্ত অবাক করেছে, কখনও কষ্ট পেয়েছি, গুমরে কান্না নিয়ে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। নিজের অজান্তেই করুণাও হয়েছে এই সময়ের কিছু নারী জীবন দেখে। সেই বৈরী সময়ের কতোটা পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা যদি তা উপলব্ধি করতো তাহলে স্বেচ্ছায় কেউ কেউ যেমন জীবনধারা বেঁছে নিয়েছে তা ভাবাতো, নিশ্চয়ই ভাবাতো!!! 

এবং বলে নিতে চাই, আমি নিতান্তই একজন সামান্য পাঠক হিসেবে এটি পড়তে যেয়ে যা আমাকে ভাবিয়েছে এবং মনে হয়েছে আরো আলোচনার দাবী রাখে সেই হিসেবেই পুরো বইটি’র একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।  

৩.
এই অধ্যায়েই এসেছে ‘বিয়ে’ নিয়ে নানান মত ও ধর্মীয় মতবাদ। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। হিন্দুরা বিবাহকে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে মনে করেন। 

হিন্দু বিয়ে হচ্ছে স্বামীর অধীনে নারীর কঠোর দাসত্ব। স্বামীর প্রভুত্ব নিশ্চিত করার জন্য ঋষিরা শ্লোকের পর শ্লোক লিখে স্বামীকে উত্তীর্ণ করেছেন ঈশ্বরের পর্যায়ে। 

হিন্দু শাস্ত্র মতে আট রকমের বিয়ের কথা বলা হয়েছে, এবং প্রায় প্রতিটিতেই ‘পতি’কেই মহিমান্বিত করা হয়েছে।

জেনে বিস্মিত হয়েছি, ‘বিবাহ’ স্বামীকে স্ত্রীর দেহের ওপর সর্বতোভাবে এমন অধিকার দিয়েছে যে, স্বামী তার স্ত্রীর দেহকে সম্ভোগ সামগ্রীর মতো ইচ্ছামত ভোগ করবে; সে বিষয়ে স্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দাম থাকবে না। 

এই বিষয়ে উপনিষদে যা আছে 'স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে তাহলে প্রথমে তাকে মধুর বাক্যে বশীভূত করবার চেষ্টা করবে। সেটা নিস্ফল হলে তাকে ‘কিনে নেবে’ (আভরণ ইত্যাদি দেওয়ার লোভ দেখাবে বা দেবে), তাতেও যদি সে রাজি না হয় তা হলে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মেরে স্ববশে আনবে'। 

শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুযায়ী নারীর জন্মই হয় পুত্রপ্রজননের জন্য। কৌটিল্য বলেছিলেন 'পুত্রপ্রজননের জন্যেই স্ত্রীলোকের সৃষ্টি, সুতরাং আট বছরের মধ্যে কোন সন্তান প্রসব না করলে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করবে'। 

এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আরো অনেক মতবাদ আছে এই অধ্যায়টিতে, এখানেই এসেছে ‘বহুবিবাহ’ প্রসঙ্গ। 

প্রাচীন বাংলায় একটিমাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সমাজের সাধারণ নিয়ম। তবে রাজরাজড়া, সামন্ত-মহাসামন্তদের মধ্যেও অভিজাত সমাজে অর্থাৎ সম্পন্ন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বহুবিবাহ অপ্রচলিত ছিল না। 

ইসলাম ধর্মে বিয়ে একটি আইনগত সামাজিক এবং ধর্মীয় বিধান। ইসলামে বিয়ে বলতে দুপক্ষের একটি চুক্তি বোঝায়। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের জন্যে আবশ্যিক কর্তব্য। 

ইসলামে বিয়ে বিষয়ক আরো অনেক তথ্য আছে এই অধ্যায়ে। 

কুরআনে আরো উল্লেখ আছে 'তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার'।

একাধিক বিয়ে বিষয়ক যে নির্দেশনা কোরআনে আছে সেটিও এখানে লেখক তুলে ধরেছেন, যাঁদের জানা নেই বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে পড়ার পর ভাবাবে।

হাদিসে উল্লেখ আছে, 'সৎস্বভাবা স্ত্রীগণ স্বামীর বাধ্যগত জীবন যাপন করিয়া থাকে। যদি তোমরা কোন স্ত্রীর অবাধ্যতার সম্মুখীন হও, তবে প্রথমে তাহাকে বুঝিয়ে, প্রবোধ দিয়া নছীহত করো এবং আরও অধিক কড়া কড়ির আবশ্যক হইলে তাহার প্রতি ভৎর্সনাস্বরূপ তাহার বিছানা ছাড়িয়া ভিন্ন বিছানায় থাক এবং আর আবশ্যক হইলে তাহাদিগকে মারিতে পার। ইহাতে যদি স্ত্রী বাধ্য হইয়া যায়, অতঃপর আর তাহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার অজুহাত খোঁজ করিও না'। 

হাদিসে আরো আছে, 'স্বামী তাহার স্ত্রীকে স্বীয় বিছানায় আসিবার জন্য ডাকিলে যদি স্ত্রী স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয় এবং স্বামী তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট হয় তবে ভোর পর্যন্ত সারারাত ফেরেশতাগণ ঐ স্ত্রীর প্রতি অভিশাপ করিতে থাকেন'। 

লেখক নিয়ে এসেছেন দাসীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কুরআনে যে নির্দেশ আছে এবং ভীষণ উল্লেখযোগ্য আরো একটি হাদিস 'যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম, তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা করতে'। 

৪.
ধর্মীয় গ্রন্থাদির অনুকরণে বাংলায় সাহিত্য ও বিভিন্ন নীতিশাস্ত্রে নারীপুরুষের দাম্পত্য সম্পকের ক্ষেত্রে নারীর একনিষ্ঠা ও পতিনির্ভরতার আবশ্যকতাই নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে। 

সাহিত্যের নানান ধারার যে লেখাগুলো এই অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে তা যেন আমাদের অন্য একটা চিন্তা জগতে নিয়ে বসিয়ে দেয়। 

অষ্টাদশ শতকের কবি আবদুল্লাহর দোক্কাতুন নাছেহিন পুথি থেকে নারীপুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন – স্বামীর বস্ত্র ধৌত করা বহু পূণ্য কর্ম। স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য বাড়ি বেড়াতে গেলে সকল প্রাণী তাকে অভিশাপ দিতে থাকে। 

দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর অসন্তোষের কথা পুরনো বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি করে বলা হয়েছে। নারীদের পতি নিন্দা বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যের একটা বিশিষ্ট অংশ। এতে সাধারণ নায়কের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন নারীকে নিজের স্বামীর দোষত্রুটি অসম্পূর্ণতা নিয়ে বিলাপ করতে শোনা যায়। 

উনিশ শতকে স্বামী দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠার অনুকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল না। সামাজিক ও পারিবারিক মুল্যবোধে স্বামী স্ত্রীর দিবালোকে সাক্ষাৎ হওয়াও অত্যন্ত গর্হিত বিবেচিত হতো।\

৫.
এরপরই এসেছে বাল্যবিবাহের কথা। প্রথম অধ্যায়ের এই চ্যাপ্টারটি পড়তে যেয়ে আমার বুকের মাঝে ভীষণ একটা চাপ কষ্ট অনুভব করেছি। অনেক অসহায় বিষণ্ণ কিশোরী মুখ যেন নিজের অজান্তেই মনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে গেছে। 

প্রাচীন হিন্দু আইনপ্রণেতা মনু, নারীর বিয়ের বয়েস নিয়ে বলেছেন ১২ বছরের কন্যা এবং ৩০ বছরের পুরুষ, চব্বিশ বছরের পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে, নইলে ধর্ম নষ্ট হয়। 

তবে জানা যায়, মোঘল আমলে মুসলমান সমাজে অভিজাতদের মধ্যে বাল্যবিবাহ কম ছিল। হিন্দু নারীর তুলনায় মুসলিম নারীর অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে বিয়ে হতো। 

তবে আদমশুমারী বা অন্যান্য সব তথ্য এবং নানান আত্মজীবনীতে যে বর্ণনা উঠে এসেছে এই বিষয়ে সবই বড় বেশি মর্মান্তিক কষ্টের। 

শুধু বাল্যবিবাহই হতো না। তাদের অনেককেই খুব অল্পবয়সেই মৃত্যুবরণ করতে হতো। এত অল্পবয়সে দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবেশে হয়তো শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিল না তার উপর এত অল্পবয়সে সংসারের কাজের বোঝা বহন করার ক্ষমতা বাল্যবধূদের ছিল না। 

যে দুইটি উদ্ধৃতি পড়তে যেয়ে আমি বেশ কিছু সময়ের জন্যে অন্য এক বোবা কষ্টের ভুবনে চলে গিয়েছিলাম, কষ্ট চাপা দিয়ে সামনে এগিয়েছি তা উল্লেখ করি। 

হৈমবতী সেনের আত্মজীবনী 'স্বামীর ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় অনুভব করি কেউ আমার কাপড় সরিয়ে নিচ্ছে, ভয়ে চিৎকার করি'। হৈমবতীর আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে স্বামীর বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক আবিষ্কারের পর তার প্রতিক্রিয়ার কথাও। 

১৮৭৫ সালে জুন মাসের ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকা বরাতে যে নিউজটি হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে দেয় 'স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে এগারো বছরের এক বাল্যবধূর মৃত্যুবরণ'। এবং ১৮৯০ এ দশ বছরের ফুলমণি স্বামী হরিমোহন মাইতি (৩৫) দ্বারা ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

(চলবে...)