উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক (ভূমিকা-২)
প্রকাশ | ০৮ মে ২০১৭, ১৫:৫৮
উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক , বিলকিস রহমান রচিত প্রথম গ্রন্থ, তার গবেষণার আলোকে লেখা। পড়ে শেষ করলাম বইটি, পড়তে যেয়ে একটু বেশি সময় নিয়েছি, নিতে হয়েছে। আমাকে ভাবিয়েছে বইটি, তথ্য উপাত্ত অবাক করেছে, কখনও কষ্ট পেয়েছি, গুমরে কান্না নিয়ে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। নিজের অজান্তেই করুণাও হয়েছে এই সময়ের কিছু নারী জীবন দেখে। সেই বৈরী সময়ের কতোটা পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা যদি তা উপলব্ধি করতো তাহলে স্বেচ্ছায় কেউ কেউ যেমন জীবনধারা বেঁছে নিয়েছে তা ভাবাতো, নিশ্চয়ই ভাবাতো!!!
এবং বলে নিতে চাই, আমি নিতান্তই একজন সামান্য পাঠক হিসেবে এটি পড়তে যেয়ে যা আমাকে ভাবিয়েছে এবং মনে হয়েছে আরো আলোচনার দাবী রাখে সেই হিসেবেই পুরো বইটি’র একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বিস্তারিত আলোচনার আগে, ভূমিকাতে লেখক আরো উল্লেখ করেছেন, পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম, সাধারণ বিশ্বাস এবং অনেকাংশে বিজ্ঞানও মনে করে যে, নারীপুরুষের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক সমতার মূলে রয়েছে শারীরিক পার্থক্য। জীববিজ্ঞানের যে সূত্র বলে নারী ঘরে, পুরুষ বাইরে কাজ করবে, এর জৈবিক কোনো ভিত্তি নেই। সমাজ এ কর্ম বিভাজন সৃষ্টি করে।
এই বিষয়ে বেশ কিছু মতবাদ লেখক তুলে এনেছেন, চমকপ্রদ দুটি উল্লেখ করি।
মেরি অলস্টোক্র্যাফটের মতে, শিল্পবিপ্লবের আগে যুক্তরাজ্যে সকল উৎপাদী কর্মকাণ্ডে নারীপুরুষ উভয়েই অংশ নিত। শিল্পবিপ্লবের পর পুরুষ বাইরে কাজ নেয়, নারী ঘরে থেকে যায়। উৎপাদী কর্মহীন গৃহবধূ যাদের স্বামী অপেক্ষাকৃত ধনী পেশাজীবী বা উদ্যোক্তা তারা গৃহকর্ম চাকর-বাকরদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঘরে বন্দি নিষ্কর্মা শয্যাসঙ্গিনীতে পরিণত হয়। মেরি এই মধ্যউচ্চবিত্ত ও বুর্জোয়া পরিবারের স্ত্রীদের খাঁচায় বন্দি রঙিনপুচ্ছ পক্ষিকুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আমি মেরির এই মতবাদটি পড়তে যেয়ে বেশ কিছু সময় থমকে ভেবেছি, হায় এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও কি এই উপমহাদেশে এমন নারীর সংখ্যাটি নগণ্য হবে?
আরো একটি তথ্য লেখক নিয়ে এসেছেন, ‘গৃহস্থালী ও কর্মস্থল দুইই সামলাতে গলদঘর্ম কর্মজীবী মহিলাকে বেটি ফ্রিডান ‘অতিনারী’ বা Super Women আখ্যা দিয়েছেন। কারণ তাকে দুই রণাঙ্গনে নিখুঁত চরম উৎকর্ষতা অর্জন করতে হচ্ছে। স্বভাবত কর্মজীবী স্ত্রী তথা ‘অতিনারী’ কেবলমাত্র গৃহকর্মে ব্যাপৃত গৃহিণী স্ত্রীর চেয়ে কম নির্যাতিত নয়।
ভূমিকাতে তুলে নিয়ে এসেছেন লেখক আরো অনেক সমাজ বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, চিন্তাবিদ এবং অর্থনীতিবিদের মত, যার প্রায় সবগুলোই আমাদের মাঝে নানান প্রভাব এবং চিন্তার ছাপ রেখে যায়।
আমাদের অনেকেরই পড়া এবং জানা, মার্কসীয় নারীবাদীদের একটি মত, শ্রেণিমতে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে নারীনির্যাতন স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য।
মার্কসের সঙ্গে একমত পোষণ করে এঙ্গেলস বলেন, উৎপাদনের নাটাই যতদিন নারীর হাতে ছিল, ততদিন পরিবারে পরিবারে নারীর প্রাধান্য ছিল; উৎপাদনস্থল ও উৎপাদন ধারা পরিবর্তিত হলে নারীর প্রাধান্য লুপ্ত হয়, উৎপাদনে পুরুষের ভূমিকা যত বৃদ্ধি পেল নারীর ভূমিকা হল তত গৌণ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাতৃঅধিকার উৎখাত হলো। সমাজে নারীর অবস্থানের এই বিপর্যয়কে এঙ্গেলস ‘নারীর ঐতিহাসিক বিশ্ব পরাজয়’ বলেছেন। তার মতে, একজন পুরুষ নারীর একমাত্র স্বামী থাকবে, আর কোন স্বামী থাকবে না – এই তত্ত্ব পুরুষের সৃষ্টি। এর উদ্দেশ্য পিতার সম্পত্তি পুত্রে হস্তান্তর নিশ্চিতকরণ।
বইটির ভূমিকাতেই লেখক বিলকিস রহমান বলছেন, এই গবেষণায় ‘নারীপুরুষ’ সম্পর্ক বলতে প্রধানত দাম্পত্য সম্পর্কেই গণ্য করছেন। প্রশ্ন এনেছেন ‘দাম্পত্য সম্পর্ক কী? শুধু কি নারীপুরুষের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জীবন পরিচালনাই দাম্পত্য সম্পর্ক? নাকি তা কেবলই নারীপুরুষের প্রাতিষ্ঠানিক যৌন সম্পর্ক? আরো বলছেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীপুরুষের অবদান, মর্যাদা এবং ভূমিকা ভিন্নতর এবং বৈষম্যমূলক।
এইসব মতামতের ধারাবাহিকতায় আরো উল্লেখ করেছেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একটা ভাববিপ্লব দেখা দিল। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে বাঙালি জীবনে প্রেম অর্থাৎ রোমান্টিক প্রেম দেখা দিল। লেখক তার গবেষণায় আরো যে দৃষ্টিভঙ্গির অনুসন্ধানকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েছেন, সেটি রজতকান্ত রায়ের মত, ‘মানসিকতা, আবেগ, সংস্কৃতি ও যৌনমনস্কতাকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা যাবে না। নারীপুরুষের মধ্যে আবেগ-ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এগুলি প্রকাশ পায়।
উঠে এসেছে, নারীপুরুষ সম্পর্ক নিয়ে তাত্তিক মতবাদগুলোর মূল বিষয়গুলো। একদমই জানা নেই যাদের বিষয়টি, তাদের জন্যে চমকপ্রদই হবে।
প্রথম মতবাদ, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় নারীপুরুষের সম্পর্ক মূলত দেহভিত্তিক। নারীদেহ হলো পুরুষের কর্ষভূমি। এই ভূমিতে পুরুষ তার বীজ বপন করে। এই বীজবপনের প্রক্রিয়াটি তার জন্যে চরম আনন্দদায়ক হয়ে থাকে। বীজবপনের ফলস্বরূপ পুরুষ পায় তার বংশের উত্তরাধিকারী।
দ্বিতীয় মতবাদটি, প্রতিতত্ত্ব বা বিতত্ত্ব যাকে ‘দেহনির্ভরতার অস্বীকৃতি’ বলা যায়। এই মতবাদে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে নারীপুরুষের যৌনাধিকার অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। তবে নারী বা পুরুষ যে একে অপরের প্রতি কেবল যৌন আকর্ষণ বোধ করবে সেটা আবশ্যিক বলে ধরা হয় না।
তৃতীয় মতবাদটি, ‘সমন্বয়ী তত্ত্ব; বা ‘বন্ধুত্বনির্ভর’ মতবাদ। বলা যেতে পারে উপরিউক্ত দুটির সমন্বয়। মানুষের নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বের বিষয়টিকে এখানে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, যা এড়াতে মানুষ বন্ধু খোঁজে। যখন ‘মনের মানুষ’ পায়, বন্ধুত্ব পায় এবং তা চূড়ান্ত রূপ নেয়। আর এই বন্ধুত্বের চূড়ান্ত রূপেই আসে দৈহিক মিলন এবং যৌন পরিতৃপ্তি। এই মতবাদে নরনারীর দেহ বা যৌনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। একমাত্র দৈহিক আকর্ষণই নারীপুরুষ সম্পর্কের ভিত্তি, অস্বীকার করা হচ্ছে এটিকে।
আলোচিত এই তিনটি মতবাদের প্রতিফলনই আছে এই গবেষণা গ্রন্থে। লেখক তার বইটির ভূমিকার শেষ অংশে এসে বলছেন আধুনিক পরিবারে নারীপুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। স্ত্রী হলো পরিবারের নৈতিকতার প্রতিক। অন্যদিকে পুরুষ আর্থিক যোগানদাতা।
পরিবারে নারীপুরুষ সম্পর্ক বলতে মাতা-পুত্র, পিতা-কন্যা অথবা ভ্রাতা-ভগিনী এই সম্পর্কগুলোকে লেখক তার গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করেননি।
যদি প্রশ্ন উঠে, নারীপুরুষ সম্পর্ক না বলে দাম্পত্য সম্পর্ক বলা হয়নি কেন, লেখক বলছেন, যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বাইরেও দৈহিক সম্পর্কের বিষয় জড়িত তাই দাম্পত্য না বলে নারী পুরুষ শব্দ গ্রহণ করেছেন, এই সম্পর্ককে তাত্ত্বিক কাঠামোয় ফেলা কঠিন।
পুরো ভূমিকাতেই বইটি নিয়ে একটা ধারণা মনে উঠে এসেছে।
লেখক আলাদা করে প্রতিটি অধ্যায়ে তার নির্বাচিত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। প্রতিটা আলোচনার শেষে যুক্ত হয়েছে বিস্তারিত তথ্যসূত্র, যা পড়তে যেয়েও পড়তে ভালোবাসেন এমন অনেকেই চমককৃত হবেন আমি নিশ্চিত এবং আগ্রহ হবে এই বিষয়ক আরো পড়াশুনার!!!