উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক (ভূমিকা)
প্রকাশ | ০৫ মে ২০১৭, ০২:০৮ | আপডেট: ০৫ মে ২০১৭, ০২:২০
উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক, বিলকিস রহমান রচিত প্রথম গ্রন্থ, তার গবেষণার আলোকে লেখা।
পড়ে শেষ করলাম বইটি, পড়তে যেয়ে একটু বেশি সময় নিয়েছি, নিতে হয়েছে। আমাকে ভাবিয়েছে বইটি, তথ্য উপাত্ত অবাক করেছে, কখনও কষ্ট পেয়েছি, গুমরে কান্না নিয়ে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। নিজের অজান্তেই করুণাও হয়েছে এই সময়ের কিছু নারী জীবন দেখে। সেই বৈরী সময়ের কতোটা পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা যদি তা উপলব্ধি করতো তাহলে স্বেচ্ছায় কেউ কেউ যেমন জীবনধারা বেছে নিয়েছে তা ভাবাতো, নিশ্চয়ই ভাবাতো !
বইটি নিয়ে মূল আলোচনায় চলে যাই, ২৬৮ পৃষ্ঠার বইটিতে তুলে আনা হয়েছে কয়েক শত তথ্যসূত্র, উইল পরিচিতি, কর্জ পত্র, কিছু তালাকনামা, খোরাকিনামা, সরকারি দলিল ও প্রকাশনা, শতাধিক আত্মজীবনী, স্মৃতি কথা, সমসাময়িক জীবনীসমূহ। লেখককে গবেষণার জন্যে সাহায্য নিতে হয়েছে প্রচুর সংবাদ-সাময়িকপত্র, এপার বাংলা ওপার বাংলার, তথ্য উপাত্ত নিয়েছেন অনেক অনেক সংবাদ-সাময়িক পত্রের সংকলন, চিঠিপত্রের সংকলন ও রোজনামচা, সাক্ষাৎকার, শতাধিক সহায়ক গ্রন্থ এবং প্রবন্ধের।
সময়, জুন ২০১৩, বইটি শুরু হয়েছে ‘প্রসঙ্গ কথা’ দিয়ে, লেখক বিলকিস রহমান বলে দিয়েছেন ‘এই গ্রন্থটি আমার পিএইচ.ডি. অভিসন্দর্ভের উপর ভিত্তি করে লেখা। অভিসন্দর্ভটির জন্য আমাকে ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. প্রদান করা হয়’। একদম শুরুতেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন ‘নারীপুরুষ সম্পর্ক’?
লেখক বলছেন, ‘বিবি কুলসুমের রোজনামচা’ প্রথম আলোতে প্রকাশিত হলে মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমার জীবনী ও কুলসুম জীবনী-তে প্রতিফলিত আদর্শ সুখীদাম্পত্য চিত্র প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো অনেককেই। পরস্পরের বিপরীত চিত্র পড়তে পড়তে আমার মনে প্রশ্ন জাগে সেই সময়ে নারীপুরুষ সম্পর্ক আসলে কেমন ছিলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমার এই গবেষণা ‘উনিশ শতকে বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীপুরুষ সম্পর্ক’।
এই প্রসঙ্গ কথাতেই কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন, কাজটি করতে গিয়ে যাদের সাহস, সাহায্য এবং সহযোগিতা পেয়েছেন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে।
বইটির মুখবন্ধ, প্রচ্ছদ এবং লেখক পরিচিতি ছবিটি আমার এই আলোচনায় পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় যুক্ত করে দিয়েছি।
এবং বলে নিতে চাই, আমি নিতান্তই একজন সামান্য পাঠক হিসেবে এটি পড়তে যেয়ে যা আমাকে ভাবিয়েছে এবং মনে হয়েছে আরো আলোচনার দাবী রাখে সেই হিসেবেই পুরো বইটি’র একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন বইটি, সূচিপত্রেই আছে তার উল্লেখ। মুখবন্ধ, প্রসঙ্গকথা, ভুমিকা, পাঁচটি অধ্যায়, উপসংহার, পরিশিষ্ট এবং তথ্যসূত্র।
প্রথম অধ্যায়, ‘নারীপুরুষ সম্পর্ক: সনাতন মুল্যবোধ’। উনিশ শতকের শুরুতে বাংলায় নারীপুরুষ সম্পর্ক কেমন ছিল, বিশেষ করে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের আগে নারীপুরুষ সম্পর্কে যে সনাতন মুল্যবোধ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিলো তা এই অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘নারীপুরুষ সম্পর্ক: বিবাহপূর্ব প্রণয় সম্পর্ক’। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দেখতে পাওয়া যায় পাশ্চাত্য শিক্ষিত সমাজে রোমান্টিক ভালোবাসার প্রভাব। ভালোবেসে বিয়ে করার বিষয়টিও এসেছে। নারী পুরুষের বিবাহপূর্ব সম্পর্ক কিরূপ ছিল এই অধ্যায়ে তা তুলে ধরা হয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়, ‘নারীপুরুষ সম্পর্ক: পরিবারের মধ্যে দাম্পত্যসম্পর্ক’। যৌথ পরিবারে দম্পতির অবস্থান ছাড়াও বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ সহ উনিশ শতকের শেষে বাংলার মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নারীপুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছিল, নতুন মূল্যবোধ তৈরি হয়েছিলো তা তুলে ধরা হয়েছে এই অধ্যায়ে।
চতুর্থ অধ্যায়, ‘নারীপুরুষ সম্পর্ক: বিবাহ বহির্ভূত নারীপুরুষ সম্পর্ক’। উনিশ শতকে বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারে দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং এর ব্যাপকতা এত বেশি ছিল যা ‘বাবু কালচার’ বলে খ্যাত। সম্পর্কহীন বঞ্চিত স্ত্রী রেখে বারবণিতা, বাঈজি, দাসী, বাঁদি, খাদিমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন উনিশ শতকে একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল, আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে।
পঞ্চম অধ্যায়, ‘নারীপুরুষ সম্পর্ক: পরিবর্তিত পারিবারিক মুল্যবোধ’। উনবিংশ শতাব্দীতে সংবাদ-সাময়িক পত্রে, সাহিত্যে নারীর অধঃস্তনতার করুণ চিত্র বিশেষ করে অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ বা কৌলিন্যের কারণে বিধবাদের অবস্থা নিয়ে সচেতনতা, পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তিত বিশ্বাস নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নে নূতনতর ভাবনার পাশাপাশি পুরুষের অনুপস্থিতে বা স্বামীর মৃত্যুর পরে পরিবারে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তা এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তবে মূল বইটি পড়বার আগে ভূমিকাটিই অনেক বেশি মনোযোগের দাবী রাখে। কেন উনিশ শতক বেছে নিলেন লেখক, এই প্রশ্ন মাথায় আসার আগেই পেয়ে যাই লেখকের ব্যাখ্যা।
‘উনিশ শতক বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কেননা উনিশ শতককে বলা হয় বাংলার নবজাগরণের সময়। নবজাগরণ বা ‘রেনেইসান্স’ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক – সব ক্ষেত্রেই চলতে থাকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যা বাংলার পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এবং এই শতকে ‘ভদ্রমহিলাদের’ নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে কোনো মৌলিক গবেষণা হয়নি বলেই লেখক বলছেন এই ভুমিকাতেই।
বলে দিয়েছেন বড় বাধা উপকরণের সীমাবদ্ধতা, চিঠি, ডায়েরি এবং দলিলাদিতে সম্পর্কের উপকরণ খুঁজতে যেয়ে দেখেছেন সেখানে দাম্পত্য বিষয়ক প্রসঙ্গ বা যৌন সম্পর্ক সচেতন বা অসচেতনভাবেই সবাই এড়িয়ে গেছেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে ভূমিকাতেই এসেছে অনেক গবেষকের উদ্ধৃতি। সম্বুন্ধ চক্রবর্তী, উনি দেখিয়েছেন যে, মেয়েদের জীবন ও সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে এত লেখালিখি, চিন্তাভাবনা আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও নারীপুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টি দু’একজন ছাড়া কেউ আলোচনা করেননি এবং স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী পুরুষেরাও পুরুষ ও নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে পার্থক্য টানতে উৎসাহী ছিলেন।
আরো বলছেন, যে সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল, সেখানে দাম্পত্য সম্পর্কের সীমানা সহজেই অনুমিত হয়।
লেখক ভূমিকাতে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন, পূর্ববর্তী গবেষণায় দাম্পত্য জীবনের পরিচয় দিতে গিয়ে কখনো কখনো দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরে নারীপুরুষের সম্পর্কের কথা উল্লেখ হয়েছে তবে কি পরিস্থিতিতে একজন দাসী, বাঁদি বা খাদিমা অনুরূপ জীবনগ্রহণ করে এবং কী পরিস্থিতিতে কেউ উপপত্নী বা রক্ষিতা হয় অথবা বারবনিতা হিসেবে নাম লেখায় তার বিশদ অনুসন্ধান পূর্ববর্তী গবেষণায় পাওয়া যায় না।
উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকাতে উঠে এসেছে দাম্পত্য সম্পর্কে ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা, হিন্দু ও মুসলিম ধর্ম আইনে নারীপুরুষ সম্পর্কের বিধান ও নীতিশাস্ত্রে তুলে ধরা দাম্পত্য চিত্র এবং সনাতন মূল্যবোধের কথাও।
ভুমিকায় লেখকের যে অনুসন্ধানটি আমাকে ভাবিয়েছে, ‘বিবাহপূর্ব প্রণয় বলতে একসময় একধরণের সমাজ বিগর্হিত ও কুলষিত সম্পর্ক বোঝাত, উনিশ শতকের বাংলা নাটক/প্রহসনে এর যথেষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।
লেখক উনিশ শতকে বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারে নারীপুরুষ সম্পর্ক গবেষণা ব্যাখায় বলছেন, বিষয় নির্বাচনে, ‘বাংলা’ বলতে ঔপনিবেশিক বাংলা, অবিভক্ত বাংলা অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং এর দুটি প্রধান শহর কলকাতা ও ঢাকাকেই, গবেষণার মূল স্থান হিসেবে নিয়েছেন। প্রাধান্য দিয়েছেন, শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণিকে।
বাংলায় গোটা উনিশ শতক জুড়ে সামাজিক পরিবর্তনের যে পালা বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে পড়ে তার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
লেখক আরো জানিয়েছেন, এই গবেষণায় মূলত সনাতন ইতিহাস গবেষণার ধারা অনুসরণ করা হয়েছে, নেয়া হয়েছে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পদ্ধতিরও।
প্রশ্ন আসতেই পারে গবেষণায় মধ্যবিত্তশ্রেণি কারা, ভূমিকাতেই পেয়ে যাচ্ছি তারও ধারণা ‘সাধারণ অর্থে মধ্যবিত্তশ্রেণি বলতে তাদেরকেই বলা হয়, যারা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বুদ্ধিমত্তা ব্যাবহারের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমাজ কাঠামোয় এক স্থায়ী অধিষ্ঠিত স্তর গঠন করেছে।
মধ্যবিত্তশ্রেণির বৈশিষ্টের মধ্যে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যসবোধ, কর্মক্ষেত্রে উন্নতিলাভের প্রয়াস, সামাজিক- সাংস্কৃতিক মুল্যবোধ, সম্মানবোধ, পরিবারের ও সন্তানের শিক্ষা এবং একক পরিবারের প্রতি আকর্ষণ অন্তর্ভুক্ত।
জানতে পারি এই ভূমিকাতেই বাংলা ভাষায় ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দের আবির্ভাব হয় উনিশ শতকের প্রারম্ভে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এটি বাংলার শিক্ষিত সমাজে ব্যাপকভাবে ব্যাবহৃত হতে থাকে এবং তখন এটি ভদ্রলোকের সমার্থক ছিলো।
এই বিষয়ক আলোচনার ধারণাকেই লেখক ঈষৎ সম্প্রসারিত করে শিক্ষিত পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী ছাড়াও ভূস্বামীশ্রেণি এবং অবস্থাসম্পন্ন কৃষককেও এই গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে ‘উনিশ শতকে ইংরেজ শাসনের অভিঘাতে সমাজব্যবস্থায় কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। গ্রামকেন্দ্রিক স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজে ভাঙ্গন ধরে, জীবনযাত্রা হয়ে উঠে শহরমুখি। এবং কতিপয় হিন্দু পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বাংলায় আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির প্রাথমিক বিকাশ হয়েছিলো ১৮৩৫ এ।
১৮৭০ সালের দিকে সরকার দৃষ্টিপাত করেন মুসলমান সমাজের পশ্চাৎপদতায়। ১৮৭১ থেকে ১৮৮৫ পর্যন্ত শিক্ষা বিষয়ে মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ভূমিকার যে তথ্যটি আমার কাছে ভীষণ চমকপ্রদ, ‘উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মফস্বল শহরগুলো ছিল প্রায় নারীবর্জিত। গ্রামই ছিল মানুষের স্থায়ী ঠিকানা ও পরিচয়, চাকুরেদের জন্য শহর ছিল অস্থায়ী নিবাস। সামাজিক উৎসবে সরকারী ছুটি হলে মানুষ ছুটে যেত পৈত্রিক নিবাস গ্রামে, শহর হয়ে পড়তো জনশূন্য।