সংগ্রামী নারীদের প্রেরণাস্থল- নিষিদ্ধ দিনলিপি

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:৫৩

মিলু কাশেম

জেসমিন চৌধুরী আমার ফেসবুক বন্ধু। ফেসবুকে তার চমৎকার সাহসী উচ্চারণের জীবনঘনিষ্ঠ লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমি তাকে চিনেছি জেনেছি। আমি তার লেখার মুগ্ধ পাঠক।

জেসমিনের নিজের জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতের জীবনবোধ সম্পন্ন অনুভূতির গল্প পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে। সম্প্রতি প্রকাশিত তার বই ‘নিষিদ্ধ দিনলিপি’র অনেকগুলো লেখা আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছি।

যেমন তার বিষয়বস্তু তেমনি প্রাঞ্জল ভাষায় সহজ সরল তার বর্ণনা। পড়া শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না। পাঠককে ধরে রাখার মতো ঘটনা প্রবাহের চমৎকার ধারাবাহিকতা আছে প্রতিটি লেখায়।

বিভিন্ন বিষয়ের উপর সম্ভবত ৪০টি ভিন্নধর্মী লেখা আছে তার বইটিতে। লেখাগুলো ঠিক প্রবন্ধ বা গল্প নয়। সবগুলো তার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার স্মৃতি-গদ্যক, কল্পনার কোন ছোঁয়া নেই। জেসমিন তার লেখায় বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতি ও সমস্যা, নারীর লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা এবং নির্যাতনের কথা নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সাহসের সাথে কোন ভনিতা ছাড়াই তুলে ধরেছেন। বাস্তবতা থেকে উঠে আসা লেখাগুলোতে নারী, শিশু ও সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের কথার পাশাপাশি শিশু ও নারীর প্রতি যৌন লাঞ্ছনা ও সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে নিপুন হাতে।

সহজ সরল ভাষায় নিজের যাপিত জীবন ও কর্মক্ষেত্রে  লব্ধ অভিজ্ঞতার ফসল তার নিষিদ্ধ দিনলিপি। তার লেখা পড়ে যেমন জেনেছি তার ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনের অনেক না-জানা কথা, তেমনি দেখেছি তার প্রতিবাদী নারী-রূপ, দৃঢ় মনোবল, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর অপার মাতৃস্নেহ। 

‘নোরা একটি লাইট হাউসের নাম’ লেখাটি পড়ে জেনেছি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জেসমিনের জীবনে সাহসের বীজ ও মুক্ত চিন্তার চারা বপন করে দেয়া অনন্য ভিনদেশি নারী ‘নোরা’র কথা। জেনেছি তার সমকামী বন্ধু মেলিনার জীবন সংগ্রামের কথা ‘আমার সমকামী বন্ধুরা’ লেখাটিতে। ‘একটি মৃত্যু এবং আমার স্বীকারোক্তি’ গল্পটিতে তার বাসার কাজের ছেলে রাসেলের কথা পড়তে গিয়ে আমি নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। এই গল্পে জেসমিনকে দেখা গেছে অসাধারণ আবেগ প্রবণ এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একজন নারী রূপে। সর্বোপরি বইটির দু’টি লেখা ‘আমার লড়াকু বাবা’ এবং ‘কেমন বাবা কেমন মানুষ?’ লেখাটি পড়ে আমরা জেনেছি তার বাবা বীর মুক্তিযুদ্ধা প্রয়াত কর্নেল এ আর চৌধুরী ও তার পরিবারকে।

নিষিদ্ধ দিনলিপিতে বর্ণিত গল্প বা ঘটনা প্রবাহ জেসমিনের নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য সব বাস্তব কাহিনী যা অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত। এরকম অভিজ্ঞতা বা ঘটনা আমাদের সমাজে অনেকের জীবনেই অহরহ ঘটে কিন্তু জেসমিনের মত প্রতিবাদী বা সাহসী হয়ে উঠতে পারে না অনেকেই। এতোটা মানবিক মূল্যবোধ বা প্রতিবাদী মনোভাব চাইলেই অর্জন করাও যায় না। এখানেই জেসমিনের সার্থকতা।

তার বইটি প্রচলিত প্রবন্ধ বা গল্পের বই থেকে আলাদা। যদিও অধিকাংশ লেখায় নারীর প্রতি অবিচার, অবহেলা, ও নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে তবুও সেই অর্থে তিনি কট্টর নারীবাদী লেখক নন। তিনি সামাজিক ব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছেন নিজের মতো করে, পুরুষের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন না করেই। তার প্রতিবাদ মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। জীবন সংগ্রামে লিপ্ত মানুষ বিশেষ করে নারীদের সাহস ও প্রেরণা জোগাবে তার লেখাগুলো।
 
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান অসঙ্গতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির আন্দোলনে জেসমিন তার লেখার মাধ্যমে নারী জাগরণে অগ্রনী ভূমিকা রাখবেন বলে আমি আশাবাদী। আমি জেসমিন চৌধুরীর 'নিষিদ্ধ দিনলিপি'র বহুল প্রচার কামনা করছি। পাশাপাশি জীবন সংগ্রমে লিপ্ত নারীদের বইটি পড়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। লেখলেখিতে জেসমিনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।

লেখক: কবি ও লেখক