পাঠ প্রতিক্রিয়া
অন্যায়ের বিপরীতে নীরবতার চেয়ে বড় পাপ আর নেই
প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:৫৬ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:৫৯
বই: নীরবতা আমার নতুন লজ্জা
লেখক: জেসমিন চৌধুরী
প্রকাশক: নালন্দা প্রকাশনী (প্যাভিলিয়ন নং ১০)
আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষা জীবনের শুরুই হয় নীরবতা শিক্ষা দেবার মাধ্যমে। শেখানো হয়- বড়রা ভুল করলেও নীরব থাকতে হয়, নীরবতাই ভদ্রতা। শেখানো হয়- বোবার কোন শত্রু নাই। শেখানো হয়- বিশেষ করে মেয়েদের নীরব থাকাই শ্রেয়, নীরবতায় ঝামেলা এড়ানো যায়। এভাবে নীরব থাকার শিক্ষা পেতে পেতে আমরা একসময় নীরবতাকেই জীবনের অংশ বানিয়ে ফেলি। নিজের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার চেয়ে নীরবতাকেই আমাদের কাছে নিরাপদ মনে হয়। আর অন্যের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ে তো নীরবতাই নিরাপদ! কিন্তু, ভেবে দেখার সময় এখনই- আসলেই কি নীরবতা শোভন? কখনো কখনো নীরবতাকে খানখান করে ভেঙে দিয়ে সরব হওয়া নিজের জন্য, এই সমাজের জন্য খুবই প্রয়োজন নয় কি? আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি কখনো কখনো নীরবতাই পাপ।
আমার পরিচিত নারীদের অধিকাংশই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীরবতার আশ্রয় নিয়েছেন, এই বইটি তাদের সবার জন্য। পড়ুন, এবং নিজেই বিচার করুন, নীরবতা আপনার জন্য সত্যিই কোন মঙ্গল বয়ে আনে কি?
বইটির প্রধান আলোচিত বিষয় হচ্ছে নারী। আমাদের সমাজে নারীর জীবন কতটা অবহেলিত,কত নারীর জীবনে অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলবার আগেই চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়, আবার কীভাবে সকল সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়া একজন নারীও ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবনের কাছ থেকে নিজের পাওনা কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নিতে পারেন, তার রূপরেখা আঁকা আছে এই বইতে।
আমাদের জীবনের শুরুটা হয় বাবা মা'র হাত ধরে। সেই বাবা-মা কি সবসময় সন্তানের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন? সন্তানের ভালো করতে গিয়ে কখনো কি সন্তানের আকাশ অমঙ্গলের ঘনঘটায় ঢেকে দেন না? উন্নত বিশ্বে কিভাবে একটা শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, কিভাবে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিকশিত হবার সমস্ত আয়োজন ছোটবেলা থেকেই করে রাখা হয়? পক্ষান্তরে আমাদের সমাজে মা-বাবার অসচেতনতার কারণে কীভাবে অনেক প্রতিভা অকালে হারায়? এই বিষয়গুলো অনুধাবন করার জন্য প্রত্যেক বাবার, মায়ের, সন্তানের, সর্বোপরি এই সমাজের প্রতিটি দায়িত্ববান মানুষের এই বইটা পড়া উচিত।
পারিবারিক নির্যাতন কীভাবে একটা মানুষের জীবনের সকল সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়, কীভাবে আমাদের চোখের সামনেই আমাদের বাচ্চারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের সাথে শক্ত বন্ধন আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকায় তা বলতেও পারছে না, পরিবারের সাপোর্ট একটা বাচ্চার নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য কতটা অপরিহার্য, এসব অনুধাবন করার জন্যও বইটা পড়া প্রয়োজন।
আজো সমাজের উঁচু থেকে নিচু সকল স্তরে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, অবমাননাকর বিভিন্ন প্রথা চালু আছে, অভ্যাস আছে, সূক্ষ্ণ বা স্থূল সামাজিক রাজনীতি আছে। অনেকে বলবেন, আজকের নারীরা যোগ্যতায় অনেক ক্ষেত্রে পুরুষকেও ছাড়িয়ে গেছে, তাই নারীরা আজ আর নির্যাতনের বা বৈষম্যের শিকার নয়! তাদেরকে বলবো, আপনারা বইটি পড়ে দেখেন। যেখানে একটা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কেউই নারীর প্রতি নিরপেক্ষ হতে পারে না, সেখানে কীভাবে একজন নারীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন সম্ভব?
বইয়ের একটি অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না কিছুতেই,
“আমরা লোহা হবো, আগুনে পোড়ানো পেটানো শক্ত লোহা, যা কারো আঙুলে শোভা পাবে না, বরং হাতুড়ি আর পেরেক হয়ে সমাজের সব অসামঞ্জস্যতাকে মেরামত করবে। হাজার বছরের পুষ্পিত শৃঙ্খলের প্রেমে পড়ে থাকা নারীর ঘোর কাটতে হয়তো আরও সময় লাগবে কিন্তু পরিবর্তনের জোয়ার শুরু হয়েছে, একসময় তা তীরে এসে পৌঁছবেই।”
কথাগুলো যেভাবে ভেতরকার শক্তি জাগিয়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্রও প্রতিফলিত করে।
লেখকের ভাষায়... উনি যা দেখেন তাই লিখেন, এই বইটি মূলত উনার স্মৃতিগদ্য। আমিও বইটি পড়ে প্রথমে এই কথাটাই ভেবেছি- লেখক যা দেখেছেন, তা আমাদের সবার দেখা উচিত। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে আমাদের বুঝা উচিত, আর তা দেখতে গেলে কী করতে হবে? বইটি পড়তে হবে। বইটি পড়ে আমার ভেতরে একটা তাগিদ অনুভব করেছি, বইটা অনেককে পড়াতে ইচ্ছে করছে। বইটিতে একজন লড়াকু নারীর জীবনকে দেখার, জীবন থেকে সিঞ্চিত অভিজ্ঞতার আরক আছে, যা পান করলে কেউ ঠকবে না, বরং ঋদ্ধ হবে।
পুনশ্চঃ লেখকের মোট চারটা বই আমি পড়েছি- নিষিদ্ধ দিনলিপি, একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা, উড়াল, নীরবতা আমার নতুন লজ্জা। এর মধ্যে দুটো উপন্যাস আর দুটো কলাম সংকলন। চারটি বই সম্পর্কেই প্রায় একই রকম অনুভূতি আমার। জীবনকে নিয়ে ভাবতে, স্বপ্ন দেখতে, নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বইগুলো শক্তি জোগাবে।