পাঠ প্রতিক্রিয়া
'পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে'
প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:৩৫ | আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:৩৯
বাংলাদেশের নারীবাদী সাহিত্য নিয়ে যতটুকু পড়েছি আমার চোখে এই বইটির উল্লেখ চোখে পড়েনি। কেন পড়েনি তা এক বিস্ময়! জানি না আমার পড়ার বাইরে যদি কিছু থেকে থাকে। কোনও অজানা কারণে, কোনও নীরব ষড়যন্ত্রে আকিমুন রহমানকে কি মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল?
পিরিয়ড- এক কিশোরীর পিরিয়ডকালীন সময়ের ভীতি আর অস্বস্তি নিয়ে উপন্যাসের শুরু। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটিকে কেউ 'হ্যাপি ব্লিডিং' বলে কিছু শেখায় বা জানায় নাই। সেইসময় প্যাড ব্যবহারের কোনও বিষয় ছিল না। মাসের পাঁচটি দিন এক অনামা দুর্বিষহতার মধ্য দিয়ে কাটে তার। তার নাম শামীমা।
"আমি আমার পিরিয়ডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ওই গদগদে দিনগুলোর কথা মনে হলেই ঘেন্নায় আমার মন থুকথুক করতে থাকে। আমি তার কথা মনেও করতে চাই না। কিন্তু এক মুহূর্তও ভুলে থাকি না। ঘেন্না করি আর অপেক্ষা করি ওই দিনগুলোর জন্যে, প্রতিমাসে। বেঁচে থাকাকে আমার কাছে কখনোই খুব সুখকর কিংবা আবেগে ফেনিয়ে ওঠার বিষয় বলে মনে হয় না, আবার বেঁচে থাকতে না পারাকেও মহা কোনও কষ্টের ব্যাপার বলে মনে করতে পারি না আমি। তবে পিরিয়ডের সময়টুকুকে আমার বেঁচে থাকার বড় দণ্ডভোগ বলে বরাবরই মনে হয়ে আসছে।"
কিন্তু গল্পটা শামীমার নয়, আমাদের অধিকাংশ নারীর।
শুধু কিশোরীবেলা কেন? শামীমা তো আনওয়ান্টেড চাইল্ড। তার মা পোয়াতী হলে বাড়ির সবাই সব আয়োজন করে পুত্র সন্তানের জন্য। আজান প্রস্তত, মিষ্টির অর্ডার প্রস্তুত- কিন্তু দাই খবর দেয় মেয়ে হয়েছে। সব আনন্দ আয়োজন থেমে যায়। গর্ভধারিণী মা কোনক্রমে শিশুটিকে নিয়ে অপরাধী আঁতুরসময়টুকু কাটায়। মেয়েটির নাম শামীমা।
কিন্তু গল্পটা শামীমার নয়, আমাদের অধিকাংশ নারীর।
শামীমার ভারবহনের জীবন শুরু হয় সেই ছোটকাল থেকেই। তখনও তার পিরিয়ড তো শুরু হয়নি। কিন্তু প্রথম সন্তান হিসেবে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ায় যে নিদারুণ অপরাধ শামীমা করেছিল তার দায় তো তারে পদে পদে শুধতে হয়। শামীমার মা এরপর আরও দুই যমজ পুত্র জন্ম দেয়, দিয়ে নিজের লজ্জ্বা অপমান মোচন করে। কিন্তু শামীমা? বাবার আদর তার পেতে ইচ্ছে করে, ভাইদের পাওয়া আদরগুলো তার পেতে ইচ্ছে করে কিন্তু সে একটা মস্ত 'ঝামেলা' সকলের কাছে। পড়তে চায় সে। পড়ার খরচ যোগাতে বিরক্ত হয় বাবা, এর তার কাছ থেকে চেয়েচিন্তে বই যোগাড় করে পড়ালেখা করে সে। শরীর বাড়ে তার। কী বিস্তর লজ্জ্বা সেই বৃদ্ধিতে! বুকের ওড়না একটুখানি সরা যাবে না। নিজের শরীরকে তার ঘেন্না হয়। ঘেন্না হয়।
কিন্তু গল্পটা শামীমার নয়, আমাদের অধিকাংশ নারীর।
এর মধ্যে পিরিয়ড ইররেগুলার হলে তার জীবনে নেমে আসে আরেক আজাব। মা তাকে সন্দেহ করে। কি করে "পেট বাঁধালো" সে, চলে তার তত্ত্ব-তালাশ। অনেক রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত সময় পেরিয়ে লাল রক্ত দেখা দিলে বাবার হাতে খুন হবার হাত থেকে রক্ষা পায় শামীমা। মায়ের উল্লসিত কণ্ঠ সে মার খেতে খেতেই শুনতে পায়, "মাসিক অইছে তো! হোনছেন, অইছে তো, হোনছেন, অইছে। অইয়া গেছে।" গদগদে ওই রক্ত না বের হওয়াটা যে মোটেও সুখকর কোনও বিষয় নয় শামীমা তা বুঝে যায়।
কিন্তু গল্পটা শামীমার নয়, আমাদের অধিকাংশ নারীর।
বাড়ির শিক্ষকের নোংরা হাত, খেলার সাথী কাজিনের শরীর হাতড়ানো, বাড়ির ফুট ফরমাশ খাটা পুরুষটির দৃষ্টি সব মোকাবিলা করে বড় হয়ে ওঠে শামীমা। সে চাকরি পায়। চেহারা ভালো নয়,গায়ের রং কালো আর দাঁত উঁচু বলে বিয়ে হয় না তার। চাকরিস্থলে যাবার সময় সুন্দরী ছোট বোনের বড়লোক ঘরের বউ হওয়া আর তার হওয়া নবজাতককে আদর আহ্লাদ করতে করতে শামীমার জন্য পুরনো লেপতোষক আর হাঁড়িকুড়ি বেঁধে দেন মা। দূরের মফস্বলে এনজিওতে চাকরি করা শামীমার সঙ্গী কেউ হয় না। সে একা। একা একটা বাড়িতে যখন ভাড়া নিয়ে থাকতে যায় সেখানকার সমাজ হামলে পড়ে তার উপর। কেন সে একা, রাতে কে আসে তার ঘরে, আপামর পুরুষেরা তার সাথে খোশগল্প করতে চায়- একলা শামীমা এই জীবনও সামাল দেয়।
কিন্তু গল্পটা শামীমার নয়, আমাদের অধিকাংশ নারীর।
শামীমার প্রেম হয়। এটিএম মনিরুজ্জামান-ডেন্টিস্ট- তার প্রেমিক। যে প্রেমিক আসলে দাঁতাল শুয়োর। যার কাছে শামীমা ভেসে ভেসে যায়, যার কাছে শামীমা ক্ষতের মলম লাগাতে যায়। কিন্তু ক্ষতের মলম কোন পুরুষটা হয় এ সমাজে? এক ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার প্রেমিক তার সাথে সঙ্গম করে। প্রেগন্যান্ট হয় শামীমা।
এবার আবার সেই লাল পৃথিবীর অপেক্ষায় ক্লান্ত হয় শামীমা। কিন্তু লালের বদলে সাদা স্রাবে ভরে যায় তার পৃথিবী। অফিসের পলিটিক্স, একলা মফস্বলে থাকার বৈরি সমাজ, সংকীর্ণ পরিবার- সবকিছুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে শামীমা প্রথমে বুঝেই উঠতে পারে না কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে। ঢাকায় গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে সে নিশ্চিত হয় প্রেগন্যান্সির। সে দৌড়ে আসে মনিরুজ্জামানের কাছে। যে খবর- গর্ভধারনের যে খবর নারীর জন্য তীব্র আনন্দের বলে প্রচার করা হয়- তা যে মোটেও অত আনন্দের নয় শামীমা সেটা বোঝে। বুঝেও সে যায় মনিরুজ্জামানের কাছে। মনিরুজ্জামান অস্বীকার করে সব। যথারীতি শামীমার গায়ে লাগিয়ে দেয় চরিত্রহীনার তকমা। কিন্তু ওই অবস্থাতেও শামীমাকে ধর্ষণ করতে ছাড়ে না সে।
কিন্তু গল্পটা শামীমার নয়, আমাদের অধিকাংশ নারীর।
কি হয় তারপর? পুরুষের পৃথিবীতে গুটিয়ে থাকা, আবডালে থাকা, নীরবে লড়ে যাওয়া শামীমা কি বাঁচে? প্রথা আর সমাজ তার জন্য আত্মহননের সব ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। শামীমা কি পা দিয়েছিল প্রথার চক্রে? না কি রুখে দিয়েছিল? দাঁড়িয়েছিল- মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল? এ্যাবরশনের টেবিলে একলা শুয়ে পড়া আজন্ম একলা শামীমা কি আসলে একা? এনেসথেসিয়ার ঘোর নিয়ে একলা শামীমা কি করে সার্ভাইভ করেছিল?
শামীমার গল্প আসলেই শামীমার একার নয়। হয়তো এইসব ঘটনা ঘটে না সকল নারীর জীবনে। কিন্তু কোথায় যে সাদৃশ্য হাজারো নারীর সাথে তার, তার এনেসথেসিয়ার ঘোর কাটানো, নিজেকে গহীন অন্ধকার থেকে টেনে তোলার এই গল্পটা কোন্ নারীর জীবনে সত্য নয়?
শামীমা ঠিক কাঁদে টাদে না। কিন্তু পুরো উপন্যাসই একটা কান্না। একটা প্রতিবাদ। একটা প্রতিরোধ। বাংলা ভাষায় এর থেকে বড় নারীবাদী উপন্যাস আমি পড়ি নাই। আকিমুন রহমান এই উপন্যাস দিয়ে আমাদের সকলের গল্প বলে যান বড় নির্মোহ সত্যে। আমি তার লেখায় প্রণতি জানাই। প্রণতি জানাই আর নির্জনে অথবা প্রকাশ্যেই শামীমার জন্য কাঁদি। কাঁদতেই থাকি। অতঃপর কান্না ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জীবন থেকে শামীমাদের হাত ধরে বের করে আনার প্রতিজ্ঞা করি।
এই বই অবশ্য অবশ্য এবং অবশ্যপাঠ্য।
বই: পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে
প্রকাশনী: অঙ্কুর প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: দেবাশীষ মান্না
লেখক: সাংবাদিক