অপরিচিত এক সাহসী একনিষ্ঠ সমাজসেবক

সৈয়দা ইসাবেলা স্মারকগ্রন্থ

প্রকাশ | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৪৬ | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৫৫

১.
আমাদের চেনা জগতের এক কম আলোচিত বড় মানুষের আলোকিত নাম সৈয়দা ইসাবেলা। কর্মে-কীর্তিতে গৌরবে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন সৈয়দা ইসাবেলা। সাহিত্যকর্মী সৈয়দা ইসাবেলা আজন্ম মানব কল্যাণে নিরন্তর ভালোবাসার আলো জ্বালিয়েছেন। মানবতার সেবায় নিজেকে আজন্ম নিবেদিত করেছেন, সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য নানাভাবে উদ্যোগী ভূমিকায় আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন। রক্ত সম্পর্কের বাইরের সকলকে নিয়েও ছিলো তার সংসার। ফলে ব্যক্তিগত লাভ-লোভ, সুযোগ-সুবিধার চেয়ে সামষ্টিক কল্যাণই হয়ে উঠেছিলো তার জীবনাদর্শের মৌলিক বৈশিষ্ট্য, মানবপ্রেমের মমতাময় ছড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে থাকার অনন্য, অসাধারণ গুণ। জীবনী পাঠ ও রচনার প্রতি আমার সবিশেষ আগ্রহের কারণেই তাকে নিয়ে রচিত সৈয়দা ইসাবেলা স্মারকগ্রন্থ পাঠের পর মহতী এই নিরলস সমাজসেবকের অজানা কাজের পরিচয় পেয়ে তাকে নিয়ে কিছুটা না লেখাটা অপরাধী করে তুলবে বলেই ধারণা জন্মেছে। কারণ প্রচারনার আলোয় দেখা মুখগুলোর ভীড়ে অপরিচিত এমন সৎ, সাহসী একনিষ্ঠ সমাজসেবকদের পরিচয় তুলে ধরাটা সামাজিক দায়িত্ব পালন বলেই মনে করি। যে দেশে তার মতোন এমন অনুকরণীয় কর্মবীরদের সম্মান জানানো হয় না, সে দেশ-সমাজ অন্ধকার থেকে আলোর আকাশ দেখতে পায়না, উৎসাহীদের প্রাণিত করতে প্রণোদনা জাগায় না। 

২.
সম্প্রতি আমার পড়া মনে দাগ কাটা, উদ্দীপনা জাগানো জীবনীচিত্র, বইয়ের নাম ‘সৈয়দা ইসাবেলা স্মারকগ্রন্থ’। উপরের কথাগুলো এই মহতী মানুষের জীবন নিয়ে পাঠ ও আলোচনার প্রেক্ষিতেই মনে জেগেছে। অনন্য জীবনসংগ্রামী ও একনিষ্ঠ শিক্ষাবিদ সৈয়দা ইসাবেলাকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন তার প্রথমা কন্যা মিতালী হোসেন, যাকে আমি চিনি-জানি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে, ১৯৮৯ সাল থেকে। যিনি আমার, আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সকলের কাছে প্রিয় মিতা ভাবি হিসেবে সম্মানিত পরম স্বজন। যতদূর মনে পড়ে, নানা সময়ে যাতায়াতের কারণে আমি তাকে মিতা ভাবীর বাসায় দেখেছি, কথা বলেছি একাধিকবার তবে সেসব সৌজন্যতাজনিত, গভীর আলাপচারিতা ছিলো না। প্রিয় কাজলের (ঘোষ) অনুরোধে একবার ঈদের পরদিন আমি সিরাজগঞ্জে তাদের বাসায় গিয়েছিলাম, সারাদিন সকলের সাথে আনন্দময় সময় কাটিয়েছিলাম। খালাম্মার সাথেও সেদিন কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই আলোকিত স্মৃতিও আজ ভীষণই মনে পড়ছে। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি আমাদের প্রিয় খালাম্মাকে। যিনি আমাদের ছেড়ে অচেনালোকে চলে গেছেন ২০১৩ সালের ১২ জানুয়ারি।

৩.
সৈয়দা ইসাবেলার পিতা সৈয়দ ইসহাক শিরাজী এবং মা আছিয়া খাতুন। তার বড় চাচা স্বনামখ্যাত সংগ্রামী, সাহিত্যসাধক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। নির্মোহভাবে বিবেচনা করলে তিনি ছিলেন তার চাচা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী। সৈয়দা ইসাবেলার স্বামীর নাম আনোয়ার হোসেন রতু। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মানব সেবার রাজনীতিতে আজন্ম নিবেদিত হয়ে আজো সমাজসেবায় সক্রিয়। এই দম্পত্তির চার কন্যা এবং এক পুত্র সন্তান আজ আমাদের সমাজে যেমন শিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত , তেমনি পিতা-মাতার স্বপ্নবীজকে মহীরুহে পরিণত করতেও সদা সচেষ্ট। সেই সক্রিয়তায় তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন মায়ের স্মৃতিতে স্বপ্ন পূরনের সামাজিক কল্যাণমূলক অলাভজনক সংগঠন ইসাবেলা ফাউন্ডেশন।

৪.
তার বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জের বাণীকুঞ্জে হলেও তার জন্ম কলকাতায়, ১৯৪২ সালে। বেড়েও উঠেছেন সেখানে। লেখাপড়ার শুরুও কলকাতার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে। কলকাতার দাঙ্গার পরে তাকে সিরাজগঞ্জে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানেই লেখাপড়া, বিয়ে, শিক্ষকতাসহ জীবনের স্বপ্নবাস্তবতার কর্মময় জীবন যাপন করেন। পারিবারিকভাবে রক্তে মিশে থাকা আজন্মের এই মহান শিক্ষক গৌরি আরবার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব অত্যন্ত সুযোগ্য, সুচারুভাবে পালন করেন টানা ত্রিশ বছর, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০২ সাল অবধি।
 
৫.
মানবতাবাদী এই মানুষটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও স্বামীর সাথে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন রৌমারী অঞ্চলে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের চেতনার প্রবল ধারক তিনি পচাত্তরের পট পরিবর্তের পরে নানাভাবে হেনস্থার শিকার হলেও দৃঢ়তার সাথে, সততার জোরে উতরে উঠতে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখেন, উত্তরোত্তর সমৃদ্ধতর করেন। নারী স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে আমৃত্যু চেষ্টা করেছেন শিক্ষার মাধ্যমে নারীকে মানুষ হিসেবে আপন মহিমায় বিকশিত করতে। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের কল্যাণে সবিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা ও নানান কর্মকান্ড মানবিক সমাজসেবক হিসেবে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতেই হয়।

৬.
তার মতোন আক্ষরিক অর্থেই প্রগতিশীল মানবিক মানুষকে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতেই রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে সৈয়দা ইসাবেলা স্মারকগ্রন্থটি। সমাজের বিভিন্ন স্তরে, একেবারে তৃণমূলে নিরবে-নিভৃতে আপনাকে বিলিয়ে দেওয়া সমাজসেবক, মানবতার সাধকদের অনন্য জীবনের জলছবি হয়ে উঠেছে সৈয়দা ইসাবেলা স্মারকগ্রন্থটি। তার চেনা-অচেনাজনের, স্বজনদের কলমে, শব্দ-বাণীতে চিত্রিত হয়েছে মানবতার জয়গানে নিবেদিত মানুষটির স্মৃতিচিত্র, লেখক ও স্বপ্ন বিনির্মাণ কর্মী মানুষ হিসেবে মহত্ত্বর গুণাবলীর আবেগমালা। সৈয়দা ইসাবেলা স্মারকগ্রন্থটিতে তাকে এবং তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে লিখেছেন যারা তাদের মধ্যে রয়েছেন কবীর চৌধুরী, ইমদাদুল হক মিলন, আহমাদ মাযহার, আসলাম সানী, কবি কাজী রোজী, কবি মোহন রায়হান, কাজল ঘোষ, সমুদ্র গুপ্ত, রবীন্দ্র গোপ, আলম তালুকদার, তপন বাগচী, রিফাত নাহার শাপলা প্রমুখ। আরো লিখেছেন তার কন্যাগণ, জামাতা, নাতজামাইসহ স্বজনদের অনেকেই। তাদের সকলের প্রীতির স্মৃতিময় রচনায় ফুটে উঠেছে অনন্য মানুষ হিসেবে সৈয়দা ইসাবেলার অনবদ্য ভূমিকা যা পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যায়, আবেগকে গভীরভাবে তাড়িত করে, জীবনকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে। স্মৃতিময় রচনার সাথে বিরল সবি চিত্রমালার সমাহারে সৈয়দা ইসাবেলা স্মারকগ্রন্থটি হয়ে উঠেছে মনে রাখবার মতোন অনন্য মানুষের জীবনচিত্রের দুর্লভ স্মারক হিসেবে।

৭.
একজন সফল ও সুযোগ্য স্ত্রী, মা, দাদী-নানী হিসেবে যেমন, তেমনই আমাদের মতোন রক্তের বন্ধনের সীমানা পেরুনোদের সকলের কাছে পরম প্রিয়, শ্রদ্ধেয় এই প্রয়াত স্বজনের, সমাজসেবিকার আত্মার শান্তি কামনা করি। সেই সাথে তার মতোন অনুসরণীয় মানুষদের জীবনের দ্বারা উজ্জ্বীবিত হতে, পাঠের দ্বারা প্রণোদিত হতে এই স্মারক গ্রন্থটির বহুল পাঠ ও প্রচারণাও আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করি। প্রথম প্রকাশ : ২০১৪, প্রকাশক : পারিজাত প্রকাশনী, প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ , মূল্য : ৩০০ টাকা।

৮.
উল্লেখ যে, ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় বর্ষপুর্তি উপলক্ষে আগামী ২৪ ডিসেম্বর, সোমবার, বিকেল ৩টায় রাজধানীর পাবলিক লাইব্রেরিস্থ শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে আলোকচিত্র প্রদর্শনী, গুণীজন সংবর্ধনা, চলমান নানা কার্যক্রম এবং ভবিষ্যত কার্যক্রমের উপর প্রামান্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ জনপ্রিয় লেখক, শিক্ষক ড. মু. জাফর ইকবাল, কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনসহ প্রমুখ গুণীজন উপস্থিত থাকবেন। এই আয়োজনে উপস্থিত থাকার, সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য, ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সকলকে আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।