সেলিনা পারভীন: নির্ভীক সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী

প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৪

অনলাইন ডেস্ক

পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী নবউদীয়মান বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে খুন করে দেশের শিক্ষক-সাংবাদিক-ডাক্তার সহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। তাদের এই কাজে সহযোগিতা করে এদেশীয় জামাতি দোসর-রাজাকার, আল বদর, আল-শামস এবং বিহারীদের নিয়ে ঘঠিত কিলিং স্কোয়াড। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলির মধ্যে স্বনামে উজ্জ্বল একজন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। তিনি সাপ্তাহিক বেগম, সাপ্তাহিক ললনা, ও শিলালিপি পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
 
শৈশব
সেলিনা পারভীনের জন্ম ফেনী তে ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ। তাঁর পিতা মো: আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ই তিনি সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে গল্প ও কবিতা লিখা শুরু করেন। গ্রামীণ কুসংস্কারের মারপ্যাঁচে তাঁর পড়ালেখার সাময়িক ইতি ঘটে তখন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁর অমতে তখনকার প্রথামত বিয়ে দেয়া হয়। তিনি ঐ বয়সে স্বামীর সাথে থাকার কথা ভাবতে পারেননি। ১০ বছর টিকেছিল সে বিয়ে। পরবর্তীতে তিনি আবার পড়ালেখা শুরু করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মেট্রিকুলেশনে কৃতকার্য হননি।

কর্মজীবন
১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল পরিচালক হিসেবে চাকুরি নেন। পরের বছর কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তিনি চাকুরি ছেড়ে দেন। তিনি পরবর্তীতে একজন রাজনৈতিককে বিয়ে করে তাঁর সাথে সংসার শুরু করেন। তিনি ললনা পত্রিকায় কাজ করতেন বিজ্ঞাপন বিভাগে৷ বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলা সব কাজ একাই করতেন৷ পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসাবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না৷ ললনায় কাজ করতে করতে ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বের করেন 'শিলালিপি' নামে একটি পত্রিকা৷ নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন৷ শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মত৷ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সকলেরই নজর কাড়লো৷ স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি৷ এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি৷ ১৯৪৫ সাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান
১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ৷ নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে৷ ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন '৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে৷ শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে আর সভায়ও৷ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি৷ এরই মধ্যে শুরু হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন৷ তাঁর বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন৷ খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন৷ শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন৷ এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা৷

চারিদিকে তখন চলছে আক্রমন, পাল্টা আক্রমন, প্রতিরোধ৷ চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু৷ এরই মাঝে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ শিলালিপির উপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ৷ হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার৷ পরে অবশ্য প্রকাশের অনুমতি মিললো তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে৷ সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তাঁর ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন৷ কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান৷ যেটাতে ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা৷ তাই কাল হলো৷ শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন৷

হত্যা
১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল৷ দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি৷ বেশ কিছু অঞ্চল ইতোমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে৷ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫নং নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়ীতে থাকতো তিনজন মানুষ- তার পুত্র সুমন, মা আর তার ভাই জনাব উজির৷ সেদিন শীতের সকালে তারা সকলেই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিল তখন সেলিনা পারভীন ছাদে একটা চেয়ার টেনে একটি লেখা লিখছিলেন। শহরে তখন কারফিউ৷ রাস্তায় মিলিটারি৷ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে৷ হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো৷ সুমনদের বাড়ীর উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে E.P.R.TC-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো৷ সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু আল বদর কর্মী৷ তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা৷ সুমনদের ফ্ল্যাটে এসে একসময় কড়া নাড়ে তারা৷ সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন৷ লোকগুলো তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এ সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়৷ এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সাথে ধরে নিয়ে যায় ৷ ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে৷ খুব শীতকাতুড়ে সেলিনার পায়ে তখনও পড়া ছিল সাদা মোজা। এটি দেখেই তাঁকে সনাক্ত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে৷ ১৮ ডিসেম্বরেই তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়৷

তথ্যসূত্র
১। স্মৃতি: ১৯৭১, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৮, বাংলা একাডেমী, ISBN = 9-840-73351-6
২। স্মৃতি: ১৯৭১, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০০, বাংলা একাডেমী, ISBN = 9-840-73351-6
৩। সমকাল
৪। মালেকা বেগম (সম্পাদক রশীদ হায়দার) (২০০৪)। স্মৃতি: ১৯৭১, ৪র্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী। আইএসবিএন 9-840-73351-6