মুঘল ইতিহাসের শক্তিশালী নারী চরিত্র ‘নূরজাহান’
প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৫২ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:০৯
‘নূরজাহান’ মুঘল ইতিহাসের পাতায় যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন। তার আসল নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। জন্মে ছিলেন উচ্চ বংশে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে। ভাগ্যক্রমে আশ্রয় পেয়েছিলেন সম্রাট আকবরের হেরেমে। সেখানেই বেড়ে ওঠেন তিনি।নাচ,গান সহ শিক্ষা লাভ করেন জ্ঞানের অন্যান্য শাখায়। রূপে-গুনে স্বয়ংসম্পূর্ণা যাকে বলে। মুঘল সাহজাদা সেলিম তার রূপে দেওয়ানা হোলে সম্রাট আকবর তার বিয়ে দেন বিহারের বীর শাসক আলি কুলি বেগ (শের আফগান) এর সাথে। তারপর অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে মেহেরুন্নিসা হয়ে ওঠেন মুঘল সম্রাজ্ঞী ‘নূরজাহান’।
জন্ম-পরিচয়
নুরজাহান বা জগতের আলো (জন্ম: ৩১ মে, ১৫৭৭ – মৃত্যু: ১৭ ডিসেম্বর, ১৬৪৫) হচ্ছে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর দেয়া নাম। তার আসল নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। মেহেরের বাবা ছিল গিয়াস বেগ। তার বাবা গিয়াস বেগ ও মা যখন তেহেরান থেকে ভাগ্যের সন্ধানে হিন্দুস্তান আসছিলেন তখন পথের মধ্যেই নির্জন মরু প্রান্তে এক বাবলা গাছের তলায় জন্ম হয় মেহেরুন্নিসার। গল্প আছে যে এই সময় গিয়াস বেগ ও তার পত্নী এমন দুর্দশায় পরেছিলেন যে মেয়ে কে বাঁচাবার কোন উপায় না পেয়ে তারা পথের মাঝেই কচি মেয়েকে শুইয়ে রেখে রওনা হন। আশা ছিল কোন সহৃদয় ব্যক্তি যদি তাকে পায় নিয়ে আশ্রয় দিবে। কিন্তু বাপ মায়ের মন। কিছুদূর যাবার পরই শিশু কন্যার কান্না শুনে তারা আর থাকতে পারলেন না। ফিরে এসে মেয়েকে বুকে চেপে নিঃসহায়, নিঃসম্বল গিয়াস বেগ এসে পৌঁছালেন লাহোরে। এবার তার ভাগ্য পরিবর্তন হল। আকবর বাদশার সুনজরে পরলেন তিনি, আর ছোট মেয়ে মেহেরের স্থান হল হেরেমে।
প্রথম বিয়ে
মেহেরের বিয়ে ঠিক হয় তুর্কিস্তানের খানদানি বংশের আলি কুলি বেগ এর সঙ্গে। আলি কুলি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, নির্ভীক ও সচ্চরিত্র যুবক। একলা খালি হাতে বাঘ মারার জন্য তার নাম হয় শের আফগান।
শোনা যায় মেহের একবার যুবরাজ সেলিমের নজরে পড়ে জান। সেলিম ও অমনি খেপে উঠলো মেহের কে বিয়ে করার জন্য। বাদশাহ আকবর এর কাছে আর্জি পউছে গেলো তার বিয়ের। কিন্তু নিজের বংশ মর্যাদার কথা ভেবে সেলিমকে নিষেধ করে আলি কুলির সঙ্গে মেহেরের বিয়ে দেন। মেহেরের বয়স তখন ষোল। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে চলে যান বর্ধমান।
আলি কুলি প্রাণ হারালেন
ইতিহাসের পট পরিবর্তন হল। আকবরের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম বসলেন সিংহাসনে। নাম নিলেন জাহাঙ্গীর। সম্রাট হয়েও জাহাঙ্গীর মেহেরকে ভুলতে পারলেন না। জাহাঙ্গীর ভেবে চিন্তে দেখলেন আলি কুলিকে যদি হত্যা(ঐতিহাসিক কোন প্রমাণ নাই) করা যায় তবেই সে মেহেরকে বিয়ে করতে পারবে। তবে আলি কুলিকে হত্যা করা সহজ কাজ ছিল না। সম্রাট কৌশলের আশ্রয় নিলেন।
শিকারে যাবার আমন্ত্রণ দিলেন আলি কুলিকে। সরল মনে আলি কুলি চললেন সম্রাট এর সাথে বাঘ শিকারে। ধূর্ত সম্রাট তাকে আদেশ দিলেন একটা ক্ষিপ্ত বাঘ মারবার জন্য। কিন্তু সম্রাট তাজ্জব বনে গেলেন। আলি কুলি খালি হাতে বাঘটিকে হত্যা করলো। এবার সম্রাট তাকে একটা পাগলা হাতির সামনে ফেলে দিলো। কিন্তু এবার ও আলি কুলি তার তলোয়ারের এক কোপে হাতির শুর দু-ভাগ করে ফেললো। আলি বুঝতে পারলো তাকে মারার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি ফিরে গেলেন বর্ধমানে।
জাহাঙ্গীর মরিয়া হয়ে বাংলার সুবেদার কুতুব কে নির্দেশ দিলেন আলি কুলিকে হত্যা করবার জন্য। কুতুব তার অনুচরদের নিয়ে হত্যা করতে গিয়ে নিজে মারা পড়লো। হতভাজ্ঞ আলি কুলি প্রাণ হারাল অনুচরদের গুলিতে।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে বিয়ে
শেরের মৃত্যুর পর মেহেরকে আগ্রাতে নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেরের বয়স তেত্রিশ। ওই বয়স এও তিনি অপূর্ব রূপসী ছিলেন। মোঘল হেরেমে থেকেও দীর্ঘ চার বছর সম্রাটকে দেখেননি। তারপর আর পারলেন না সম্রাটকে ফেরাতে। সাইত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে(২৫ মে, ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ) করেন জাহাঙ্গীরকে। জাহাঙ্গীর তার নাম দিলেন নুরজাহান বা জগতের আলো।
সম্রাজ্ঞী নূরজাহান
নূরজাহান শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। তিনি প্রায়ই সম্রাটের সাথে বাঘ শিকারে জেতেন।শক্তিশালী বাঘ শিকারি হিসেবে তার খ্যতি ছিল। কথিত আছে তিনি ৬ টি গুলি দিয়ে ৪ টি বাঘ শিকার করেছিলেন। তার বীরত্বের কবিতাও লিখেছেন অনেক কবি।
ইংরেজ দূত টমাস রো লিখে গেছেন মেহের আসলে দেশ শাসন করত। জাহাঙ্গীর ছিল নাম কেওয়াস্তে সম্রাট। সেই সময়কার মুদ্রাতে জাহাঙ্গীর এর সঙ্গে নুরজাহানের ছবিও ছাপা হত। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীর এর রাজত্তের শেষ দিকে যখন তার ছেলে খুররম ও সেনাপতি মহাব্বত খা বিদ্রোহ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন নুরজাহান।
জীবনাবসান
নুরজাহানের শেষ জীবন সুখের হয় নি। তার বিরাট উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তার জন্য দায়ী। জাহাঙ্গীর এর মৃত্যুর পর নুরজাহানও লাহোরেই থেকে যান শেষ পর্যন্ত। অবশেষে বাহাত্তর বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ওই লাহোরেই।
নুরজাহান নিজে ছিলেন কবি। তার কবরের গাঁয়ে তার রচিত দুটি লাইন দেখতে পাওয়া যায়। ফরাসিতে লেখা। কবি সত্ত্যন্দ্র নাথ দত্ত বাংলায় অনুবাদ করেনঃ
“ গরীব গোরে দ্বীপ জেলো না,
ফুল দিও না কেউ ভুলে,
শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখ,
দাগা না পায় বুলবুলে। "
সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ও জাহাঙ্গীরের ন্যায় বিচারের একটি প্রচলিত গল্প
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম শোনেনি এমন কোন শিক্ষিত লোক পাকভারত-বাংলাদেশে আছে কিনা সন্দেহ। মহান সম্রাট আকবরের পুত্র সেলিম ৩৮ বছর বয়সে ১০৩৪ হিজরীতে জাহাঙ্গীর উপাধি নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর জন্মগতভাবে বহু গুণের অধিকারী ছিলেন। এক দিকে যেমন ছিলেন বিরাট প্রতাপশালী সম্রাট, অপর দিকে তেমনি ছিলেন উন্মুক্ত হৃদয়ের প্রজা বৎসল শাসক। তিনি মনে প্রাণে সাধারণ প্রজাদের সুখ শান্তি ও মঙ্গল কামনা করতেন।
বাদশাহ জাহাঙ্গীর রাজ্যে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক ও তৎপর। সাধারণ প্রজারা যেন সহজে বিচার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ লাভ করে ন্যায় বিচার লাভ করতে পারে এ লক্ষ্যে রাজদরবারে ইনসাফের জিঞ্জির ঝুলিয়ে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, “সিংহাসনে উপবিষ্ট হবার পরে সর্ব প্রথম যে নির্দেশ আমি জারি করেছি তা হলো -ইনসাফের জিঞ্জির লটকানো হোক। উৎপীড়িত মজলুম জনগণের বিচারে বিচারালয় থেকে কোন প্রকার ত্রুটি কিংবা অবহেলা পরিলক্ষিত হলে তারা যেন সরাসরি জিঞ্জিরের কড়া বাজিয়ে আমাকে অবগত করাতে পারে।”
এই জিঞ্জিরটির এক প্রান্ত ছিল আগ্রার শাহী মহলের চূড়ার উপরে অবস্থিত,আর অপর প্রান্ত ছিল যমুনা নদীর অপর পাড়ে পাথরের একটি স্তম্ভের উপর লটকানো। এ শিকল টেনে বহু লোক জাহাঙ্গীরের ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ দিয়েছে। সম্রাটের ন্যায়পরায়ণতা ছিল মায়া মমতার ঊর্ধ্বে। তিনি এ ব্যাপারেও এত কঠিন ছিলেন যে তা উপলব্ধি করা যায় সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের বিচারের কাহিনী থেকে। নূরজাহান ছিলেন জাহাঙ্গীরের চোখের জ্যোতি ও অন্তর মস্তিষ্কের মালিক। সম্রাট নিজে বলতেন, “নূরজাহান আমার মালিক কিন্তু আমার আদল ইনসাফের মালিক নয়।” সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ছিলেন অপরূপ সুন্দরী, ভ’বন মোহিনী চিত্তহারিণী সৌন্দর্যের অধিকারিণী।
একদা বেগম নূরজাহান রাজপ্রাসাদের উপরে খোলা যায়গায় বসা ছিলেন। তার সৌন্দর্যের জ্যোতি চারদিক আলোকিত করে ঠিকরে পড়ে ছিল। এমন সময় এক হতভাগা পথিকের দৃষ্টি পড়ে সম্রাজ্ঞীর ওপরে। নূরজাহান ব্যাপারটিকে সাধারণভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। তাঁর প্রতি পর পুরুষের নজরকে অপরাধ জনক মনে করে রাগান্বিত হয়ে পথিকের প্রতি পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। সাথে সাথে হতভাগা পথিকটির মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু এমন ঘটনাটি চাপা রইল না। খবরটি পৌঁছল গিয়ে জাহাঙ্গীরের কানে। মহামতি সম্রাট ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিলেন। বেগম নূরজাহান অত্যন্ত খোলা মনে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেন। জাহাঙ্গীর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এ অপরাধের বিচারের ফয়সালা চেয়ে পাঠান মুফতী সাহেবের কাছে। মুফতি বিচারের রায়ে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে হত্যার নির্দেশ দিলেন স্বয়ং স¤সম্রাট জাহাঙ্গীর। সম্রাজ্ঞীর প্রতি এমন কঠোর আদেশ শুনে দরবারেরর সকলের অন্তর কেঁপে উঠল।
বেগম নূরজাহান ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রাণ প্রিয়া। তার নির্দেশেই প্রকৃতপক্ষে সম্রাজ্য পরিচালিত হত। সেই প্রতাপশালিনী প্রাণপ্রিয়া রাণীর বিরুদ্ধে শিরচ্ছেদের আদেশ । রাজদরবারের সকলের অন্তরে বেদনার বান উথলে উঠল। কিন্তু হৃদয়ে ভাবান্তর হল না একমাত্র জাহাঙ্গীরের। তিনি অন্দর মহলে প্রবেশ করে দাসীদের প্রতি হুকুম দিলেন নূরজাহানকে শিকল পরায়ে রাজদরবারে হাজির করতে। যেই হুকুম সেই কাজ। অন্তরে ব্যথা নিয়ে দাসীরা তাদের প্রিয় সম্রাজ্ঞীকে বাদশার হুকুমে শিকল পরায়ে রাজদরবারে হাজির করল।
নূরজাহান এমন আচরণের কোন বিরোধিতা করলেন না। বাদশাহর হুকুমে জল্লাদ এলো তলোয়ার নিয়ে। নূরজাহানের শিরচ্ছেদ করতে। নূরজাহান অসহায়। বুদ্ধিমতী বেগম সাহস করে জাহাঙ্গীরের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন , “জাঁহাপনা, শরিয়তে বিধান রয়েছ খুনের বদলা পরিশোধ করার। আমি খুনের বদলা পরিশোধ করে মুক্তি পেতে পারি কি না?”
এ সওয়ালের জওয়াব দিতে জাহাঙ্গীর আবার মুফতির কাছে ফতোয়া চাইলেন। মুফতি জওয়াব দিলেন, হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির অলীগণ যদি রাজি হয় তা হলে খুনের বদলা দেয়ার বিধান শরিয়তে রয়েছে। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী বেগম নূরজাহান নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণকে এক লক্ষ দিরহাম দিয়ে খুশি করলেন। তারা এ ভাবে খুনের বদলা গ্রহণ করে সম্রাটকে বলল, “আমরা কিসাস চাই না। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি সম্রাজ্ঞীর ওপর থেকে কিসাসের হুকুম বাতিল করুন।”
সম্রাট জাহাঙ্গীর তাদের এমন ব্যবহারে খুশি হয়ে প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞীকে কঠিন শাস্তির হাত থেকে মুক্তি দিলেন। এমন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ইনসাফের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সারা বিশ্বকে আলোকিত করে আজও মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধাসিক্ত হয়ে বেঁচে আছেন।