জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিপ্লবী কল্পনা দত্ত (যোশী)

প্রকাশ | ২৭ জুলাই ২০১৮, ২০:০৩

আবদুল্লাহ আল মোহন

১.

বিপ্লবী কল্পনা দত্ত যোশী, কল্পনা দত্ত নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম মহান মানুষ কল্পনা দত্ত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের পাশাপাশি তাঁরও ছিলো সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯১৩ সালে ২৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এই সংগ্রামী নারী। বৃটিশ যুগের স্বদেশ চেতনায় জীবনকে ঝুঁকি নেওয়া বিপ্লবী অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তের (যোশী) স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি, জানাই রক্তিম অভিবাদন ।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত যোশী একটি চিরস্মরণীয় নাম। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন সমব্যথী আর তাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কল্পনা দত্ত মুক্তিুদ্ধে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন দু’বার ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে। শেষবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিশেষ আমন্ত্রণে এসেছিলেন। 

২.
কল্পনা দত্ত ছোটবেলা থেকেই ছিলেন স্বপ্ন বিলাসী, স্বপ্ন দেখতেন সমৃদ্ধ সমাজের। তিনি ভাবতেন, পথ যতই বেদনা বিধুর হোক না কেন তা মাড়িয়ে যেতে হবে, তবেই দেখা হবে সোনালী ভোরের। কৈশোর বয়স থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিপ্লবীদের প্রতি তার আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা ছিল। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, কানাইনালের জীবনী তিনি জেনেছেন। তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হয়ে কল্যাণী দাসের বিপ্লবী সংগঠন ছাত্রী সংঘে যোগ দেন। এই সময়ে কলকাতাতেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবেই তিনি হতে পেরেছিলেন মাস্টারদার প্রিয় পাত্রী, রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিকন্যা’।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দু’জন নারীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে আছে তাঁরা হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। বিপ্লবীদের গুপ্ত সংগঠন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখা, মাস্টারদা সূর্য সেনের পরিচালনায় ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকারের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করে। এই ঘটনায় সারা ভারতের বিপ্লবী তরুণ সমাজ শিহরিত হয়।বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন স্বভাবে দরদী ও কোমল মেয়েরা বিপ্লবী কাজে অনুপযুক্ত। ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শ খারাপ হতে পারে। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, “It was an iron rule for the revolutionaries that they should keep aloof from the women.” সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এই Iron rule-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যারা তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। বোমা, পিস্তল নিয়ে কাজ করার দৃষ্টান্ত তাঁরা রেখে গেছেন।

৩.
কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিনোদবিহারী দত্ত ও মাতা শোভনবালা দত্ত। গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালী হলেও তার শৈশব ও ছাত্রজীবন সূচিত হয় চট্টগ্রাম শহরে। তার দাদু ছিলেন শহরের নামকরা ডাক্তার রায় বাহাদুর দুর্গাদাস দত্ত– পূর্নেন্দু দস্তিদার। ডা. খাস্তগীর স্কুলের শিক্ষিকা উষাদি ছাত্রীদের সাথে নানা বিষয়ে গল্প করতেন। তাদেরকে তিনি দেশ-বিদেশের স্বাধীনতার গল্পও শুনাতেন। তিনিই তার ছাত্রীদের সাথে সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীর মামলার কথা নিয়ে আলোচনা করেন।আর এভাবেই তার আগ্রহ তৈরি হয় স্বদেশ সেবার, স্বাধিকারের জন্য সংগ্রামের।

৪.
কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইংরেজ সরকার তাঁর ব্যক্তিত্বকে সম্মান দিত। ফলে তাঁদের বাড়িটা পুলিশের নজরের বাইরে ছিল। শৈশব থেকেই কল্পনা মানসিক দিক থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন। অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং স্পর্শকাতর। ভিখারিকে ভিক্ষা করতে দেখলে তিনি ভীষণ দুঃখ পেতেন। দুঃখী মানুষের দুঃখের কাহিনী শুনে তিনি ব্যথিত হয়ে পড়তেন। শৈশবে তিনি এই কামনাই করতেন সংসারে যেন দুঃখ না থাকে, সকলেই যেন সুখে দিন কাটাতে পারে। আরো একটু বড় হবার পর অর্থাৎ বারো বছর বয়স থেকেই তিনি স্বদেশী বই পড়তে আগ্রহী হন। বিপ্লবীদের জীবনী, ‘পথের দাবী’ এই রকম ধরনের স্বদেশী বই পড়তে পড়তে তাঁর মনে হতো ব্রিটিশ সরকারকে সরাতে পারলেই দেশে স্বাধীন হবে, দেশের দুঃখ দূর হবে। তাঁর ছোটকাকা তাঁকে আদর্শ দেশ-সেবিকারূপে গড়ে ওঠার প্রেরণা দিতেন। ধীরে ধীরে দুঃসাহসিক কাজের দিকে তাঁর প্রবণতা জাগে।

৫.
পড়াশুনায় মেধাবী বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনা চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯২৯ সালে। মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হন। কলকাতার ঐতিহ্যসম্পন্ন বেথুন কলেজে এসে ভর্তি হন আই এ প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান নিয়ে। বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই তিনি রাজনৈতিক জীবনই তাঁর আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা মনে জেগে ওঠে। স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে সকালে সকলের ঘুম ভাঙার আগেই বেথুন কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেলে ঘুরপাক খেতেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন। সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি দলের সদস্য হয়ে বিজ্ঞানের ছাত্রী কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন। কল্যাণী দাসের ‘ছাত্রী সংঘে’তিনি যোগদান করেন। বেথুন কলেজে হরতাল পালন এবং অন্যান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন বিপ্লবী কল্পপনা দত্ত।
 
৬.
এক সময় তিনি বিপ্লবী নেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সংস্পর্শে আসেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার ও প্রীতিলতার প্রভাবেই কল্পনা দত্ত বিপ্লবী দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের অনুগামী পূর্ণেন্দু দস্তিদার কল্পনার মতন একজন বিপ্লবী মনস্কা নারীকে পেয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এইভাবেই বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। ওই বছর মে মাসে চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের উদ্যোগে চট্টগ্রাম জেলা রাজনৈতিক সম্মেলন, যুব সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন ও নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের পর প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত কলকাতায় চলে যান। ওই সময় কলকাতায় বিপ্লবীদের এক গোপন কারখানায় তৈরি হত বোমার খোল। মাস্টারদার নির্দেশ অনুযায়ী সে বোমার খোল সংগ্রহ করেন প্রীতিলতা। ওই বছরের শেষের দিকে পুজার ছুটিতে প্রীতিলতা কল্পনা দত্ত, সরোজিনি পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রক্ষিতকে নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন। মাস্টারদার নির্দেশে বোমার খোলগুলো পৌঁছে দেন বিপ্লবীদের হাতে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন।

ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮ এপ্রিল যুব বিদ্রোহ বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠণের ঘটনাকে ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, যা ছিল দেড়শত বছরের ইতিহাসের মধ্যে ইংরেজদের জন্য খুবই অপমানজনক ঘটনা। 

৭.
১৮ থেকে ২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন কার্যত অচল ছিল। পরাধীন জাতির ইতিহাসে বিপ্লবীদের এ বিজয় ছিল গৌরবগাঁথা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল এবং ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের ঘটনায় তিনি এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে ছুটিতে চট্টগ্রাম এসে আর কলকাতায় ফেরেন নি। তখনও মাস্টারদার সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ বা কথা হয়নি। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠণের দায়ে অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ ও লোকনাথ বলসহ আরও অনেক নেতাকে গ্রেফতার করে। মাস্টারদা সূর্য সেন চলে যান আত্মগোপনে। মে মাসের প্রথম দিকে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বিপ্লবে অংশ নিতে চলে আসেন। অনেক কষ্টে তারা মাস্টারদার সাথে দেখা করতে সক্ষম হন। তারা মাস্টারদার কাছে সশস্ত্র বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। মাস্টারদা তাদেরকে বিপ্লবী দলের শপথ বাক্য পাঠ করান। এসময় প্রীতিলতা চট্টগ্রাম নন্দনকানন বালিকা মধ্য ইংরেজি স্কুলে (বর্তমানে অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) শিক্ষক হিসেবে চাকুরি নেন। আর কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে গোপনে চলতে থাকে বিপ্লবী দলের কার্যক্রম।

ধলঘাটের সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন হত্যাকাণ্ডের পর সারা চট্টগ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মিলিটারি ও পুলিশ নির্যাতন শুরু হয় গ্রামে-গঞ্জে শহরে। পাহাড়তলী স্টেশনের পাশে ভেলুয়ার দীঘির কোণায় কিছু গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলের সহায়তায় পুলিশের হাতে পড়ে বিপ্লবী কল্পনা দত্তের রাজনৈতিক কারাজীবন শুরু হয়। ১ বছর কারাগারে থাকার পর ১৯৩১ সালের মে মাসে কলকাতা থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক দ্রব্য কৌশলে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয় কল্পনা দত্তকে। 

৮.
১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে এক বিশেষ আদালতে (ট্রাইব্যুনালে) আরম্ভ হয় রাজদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জন বন্দীর বিচার (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল)। মাস্টারদা বন্দীদের মুক্ত করার জন্য এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দীদের মুক্ত করা এবং একই সাথে আদালত ভবন ধ্বংস করার উদ্যোগ নেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কল্পনা দত্ত। হামলার দিন ধার্য করা হয় ৩ জুন, ১৯৩১ সাল। সব প্রস্তুতিও গোপনে সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে সর্বশেষ মাইনটি বসানোর সময় পুলিশের নজরে পড়ে যাওয়ায় গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।

১৯৩২ সালে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য দুইবার ব্যর্থ বিপ্লবী শৈলশ্বর চক্রবর্তীর আত্মহত্যার পর মাস্টারদা বিপ্লবী প্রীতিলতাকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের ভার অর্পণ করেন। এই কারণে সূর্য সেন কাট্টলীর গোপন ক্যাম্পে আসেন। প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত দেখা করতে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। প্রীতিলতা নিরাপদে গোপন কেন্দ্রে পৌঁছে গেলেও পুরুষবেশি কল্পনা দত্ত ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালে ধরা পড়েন। মাস্টার দা সূর্য সেন সে খবর পেয়ে অনুমতি দেন প্রীতিলতাকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আবার আত্মগোপন করেন কল্পনা দত্ত। 

৯.
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রতীরবর্তী গৈরালা গ্রামে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গী ছিলেন কল্পনা। পরে মাস্টারদা ও ব্রজেন সেন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কল্পনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু তিন মাস পর ১৯ মে গৈরালা গ্রামে এক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা এবং তার সতীর্থ কয়েকজন বিপ্লবী ধরা পড়েন। প্রায় ৬ বছর কারাভোগের পর এই বিপ্লবী ১৯৩৯ সালে মুক্তি পান। ইতোমধ্যে মামলা চালাতে গিয়ে তার বাবা সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের উত্তরে যে বড় দোতলা বাড়ি (রায় বাহাদুর ডা. দুর্গাদাস দত্তের বাড়ি) ছিল তাও হারাতে হয়েছে তাকে।
 
১০.
১৯৩৮-এর প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে এলেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে — জানালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ওঁর বাবাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা ছোট্ট চিঠি দেখালেন, ‘‘তোমার কন্যার জন্যে যা আমার সাধ্য তা করেছি, তার শেষ ফল জানাবার সময় এখনো হয়নি, আশাকরি, চেষ্টা ব্যর্থ হবে না।’’ রবীন্দ্র বন্ধু সি এফ এন্ডরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য অপরিসীম পরিশ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গভর্নরের কাছে গিয়েছিলেন এবং কল্পনার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন ‘‘কল্পনা যেদিন মুক্তি পাবে সেদিন যেন তাঁকে টেলিগ্রাম করা হয়।’’ 

মহাত্মা গান্ধী কল্পনার বাবাকে সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে চেষ্টা করবেনগবলে জানান। নাজিমুদ্দিন সাহেব তৎকালীন বাংলার স্বরাষ্ট্রসচিব চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার বন্দীদের ছেড়ে দিতে নারাজ। কল্পনা দত্তের উপর ছিল তার ভীষণ আক্রোশ। আশা দিয়েছিলেন যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। ১৯৩৯ সালের ১লা মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

১১.
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে চট্টগ্রাম গিয়ে দেখেন প্রাক্তন বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টি যে পথে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে, সেই পথই ঠিক মনে হওয়ায় কল্পনা দত্তও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় চট্টগ্রামে থেকে তিনি কাজ করেছেন। সেই সময় তার বহু রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে পিপলস ওয়ার পত্রিকায়। জেলে কল্পনা দত্ত লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগী হয়ে ওঠেন। জেলে নারী রাজবন্দীদের একত্রে রাখার ব্যবস্থা হয়। সেখানে ‘পরিচয়’ মাসিক পত্রিকা পড়ার সুযোগ হলো কল্পনার। কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু শুনতেন, জায়াড-এর লেখা, কোলের লেখা, বার্নাড শ-এর লেখা সোস্যালিজম, কমিউনিজম সম্বন্ধে কিছু কিছু বইও তাঁদের কাছ থেকে পেলেন। বইগুলোর যুক্তিতর্ক মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় কল্পনাকে। এতদিনকার পড়া বিপ্লবী সাহিত্যভাবের উন্মাদনা জাগিয়ে তুলেছিল, তীব্র অনুভূতি মরণকে তুচ্ছ করতে শিখিয়েছিল।

‘‘সমাজতন্ত্রবাদ ও সাম্যবাদ’’ সম্বন্ধে এই সব বইয়ের যুক্তিতর্ককে অস্বীকার করা যায় না। কমিউনিজমের সঙ্গে বিপ্লবীদের মতের কোন অমিল নেই। কেউ কেউ যখন বলত টেররিস্টদের কমিউনিস্টরা শত্রু বলে মনে করে হেসে উড়িয়ে দিতেন কল্পনা। দু’দলের আদর্শ যখন স্বাধীনতা — তখন পার্থক্য কোথায়? তিনি বিশ্বাস করতেন কমিউনিস্টরা অনেক বেশি শিক্ষিত, পড়াশুনা করে, জানে অনেক বেশি। রম্যাঁ রল্যাঁর ‘‘আই উইল নট রেস্ট’’ বইটি পড়ে রাশিয়ার বিপ্লবের প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছিল শুধু তাই নয়, লিখেছেন ‘‘লেনিনকে পূজা করতে আরম্ভ করলাম। তার আগে রম্যাঁ রল্যাঁর লেখা সোল এনচান্টেড ও ‘জা ক্রিস্তোফ’ বই দুইটি পড়ে তার লেখার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন।

১২.
১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ওই বছর মুম্বাইতে এক সম্মেলনে কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানেই পি. সি যোশীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৪৪ সালে যোশীর সঙ্গে কল্পনার বিয়ে হয়। পি. সি যোশী তদানীন্তন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন। এরপর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে যান এবং দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে গড়ে তোলেন। ১৯৪৬ সালে আইনসভার নির্বাচনের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে প্রার্থী ছিলেন কল্পনা দত্ত। আর কংগ্রেস থেকে দাঁড়িয়েছিলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তা। কল্পনা দত্ত অবশ্য বিজয়ী হতে পারেননি।

১৩.
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হলো। জন্মভূমি ছেড়ে চলে এলেন ভারতে। কমিউনিস্ট পার্টির কাজে নিজেকে যুক্ত করলেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির প্রতিদিনের কাজে। রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে নাম করেছিলেন। দেশ ভাগ হওয়ার পরও অনেকদিন তিনি চট্টগ্রামেই থেকে যান। ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে চাকুরি নেন এবং পরবর্তী সময়ে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন। রুশ ভাষায় শিক্ষকতা করেন এবং নতুন দিল্লির রুশ ভাষা কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হয়েছিলেন। ভারতের নারী আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। কল্পনা দত্ত নারী সমিতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের মৈত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
 
১৪.
ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনার। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তাঁর লেখাগুলি গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ১৯৪৫-এ ‘চিটাগাং আর্মারি রেইডার্স রেমিনিসেন্স’ প্রকাশিত হয় বোম্বাই থেকে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৯০ সালে ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন শেষ করতে পারেননি। আরও একটি মনোবেদনা নিয়ে চলে গেছেন তাঁর জীবনের স্মৃতিকথার তিন হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন- দিল্লিতে অটোরিকশায় ভুল করে ফেলে গেছেন, ফিরে পাননি।

১৫.
আমৃত্যু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পি সি জোশী ও কল্পনা দত্ত জোশী দম্পত্তির দুই ছেলে- সুরুজ জোশী এবং চাঁদ জোশী। তারা উভয়েই পরবর্তী জীবনে সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন। তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু তাকে আঘাত করে। জীবনের সায়াহ্নে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার স্মৃতিভ্রংশ হয়। কলকাতার হাসপাতালে পাঁচ মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। শোনা যায়, ওই সময়ে কল্পনা জোশীই যে মহান বিপ্লবী কল্পনা দত্ত এটি হাসপাতালের কর্মকর্তা এবং সরকারি আমলাদের বোঝাতে নাকি বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তার আপনজনদের। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানী মেমোরিয়াল হাসপাতালে কল্পনা দত্ত যোশীর ৮২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়।

(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বিপ্লবীদের কথা, গুণিজন, সাপ্তাহিক দেশ: ২৮ ডিসে-১৯৯১, দৈনিক গণশক্তিসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা।​