ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: হার না মানা এক ভাস্কর, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশ | ০৬ মার্চ ২০১৮, ১৭:৪৫ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৮, ১৮:১৫

অনলাইন ডেস্ক

ইলাস্ট্রেশন: চারু শিল্পী

কপালে লাল বড় টিপ, চোখে গাঢ় কাজল, গলায় কাঠ, মাটি কিংবা পাথরের গয়না, শান্ত, সৌম্য চেহারা যেখানে তাকালেই এক সতত জননীর রূপ ধরা পড়ে, তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী; একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন ভাস্কর, একজন হার না মানা লড়াকু মানবী। ১৯৭১ সালে এদেশের আরো লক্ষ লক্ষ নারীর সাথে তিনিও পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হলেও তার সংগ্রাম অচিরেই শেষ হয়নি। 

জন্ম ও শৈশব
দেশভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্ম খুলনায় নানার বাড়িতে। তার বাবার নাম সৈয়দ মাহবুবুল হক এবং মায়ের নাম রওশন হাসিনা। বাবা-মায়ের ১১ সন্তানের মধ্যে প্রিয়ভাষিণী ছিলেন সবার বড়। খুলনায় তার জন্মস্থান নানা বাড়ির নাম ছিল 'ফেয়ারী কুইন' বা 'পরীর রাণী'। প্রিয়ভাষিণীর ব্যক্তি ও শিল্পী জীবনে এই নানা বাড়ির প্রভাব অপরিসীম। এই নানা বাড়িতেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। এখানেই প্রকৃতির সাথে মিলে-মিশে একাত্ম হবার প্রথম সুযোগ ঘটে তার। খুব ছোট বেলা থেকেই অনেক বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন তিনি।

শিক্ষা ও বৈবাহিক জীবন
তিনি খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন।
১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিয়ে করেন। কিন্তু সেই সংসার টিকেনি। পরে ১৯৭২ সালে প্রিয়ভাষিণী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্বামী আহসান উল্লাহ আহমেদ ছিলেন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। তার জীবন সংগ্রামে তার সবচেয়ে বড় সঙ্গী ছিলেন তার স্বামী। তাদের ছয় সন্তান। তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। 

কর্মজীবন
১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। মাঝে কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। তিনি ইউএনডিপি, ইউএনআইসিইএফ, এফএও, কানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। শেষ বয়সে এসে নানা শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন এবং তা অবিরামভাবে অব্যাহত রাখেন।

তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ভাস্কর। তার শিল্পকর্ম বেশ জনপ্রিয়। মূলত ঘর সাজানো এবং নিজেকে সাজানোর জন্য দামী জিনিসের পরিবর্তে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে কিভাবে সাজানো যায় তার সন্ধান করা থেকেই তার শিল্পচর্চার শুরু। নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিভাবে অল্প খরচে সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে সে বিষয়গুলো তিনি দেখিয়েছেন। ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের গুড়ি দিয়েই মূলত তিনি গৃহের নানা শিল্প কর্মে তৈরি করতেন।

একাত্তর ও প্রিয়ভাষিণী
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জীবনের সাথে মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস, মিশে আছে বীরাঙ্গনাদের দুর্বিষহ জীবন কাহিনী। তিনি একাত্তরের ভয়াবহ ধর্ষণ সম্পর্কে একমাত্র জবানবন্দি-দানকারী। ট্রাইব্যুনালে রাজাকার ও তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। 

সাহসী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার সাক্ষাৎকারে (একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির) জানান, “রাতে ফিদাইর (উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা) চিঠি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুলতান, লে. কোরবান আর বেঙ্গল ট্রেডার্সও অবাঙালি মালিক ইউসুফ এরা আমাকে যশোরে নিয়ে যেতো। যাওয়ার পথে গাড়ির ভেতরে তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে। নির্মম, নৃশংস নির্যাতনের পর এক পর্যায়ে আমার বোধশক্তি লোপ পায়। ২৮ ঘণ্টা চেতনাহীন ছিলাম”।

নিজের উপর হওয়া অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, "পাকিস্তানী সৈন্যরা কতো তারিখে আমার বাসায় এসেছিল তা আমার মনে নেই কারণ আমি যখন ডায়রি লিখতে শুরু করেছিলাম কিন্তু সেটা আমাকে ফেরত দেওয়া হয় নি ফলে আমি মনে করতে পারছি না। তবে সম্ভবত এটা অক্টোবরের প্রথম দিকে হয়েছিল। ২৮ ঘণ্টা বন্দি ছিলাম ক্যাম্পে"।

তিনি আরো বলেন, "...তারা আমাকে এক ঘণ্টা ধরে গালাগালি করে, শারীরিক নির্যাতন করে গাড়িতে করে নিয়ে চলল। আসলে এগুলো বলতে ইচ্ছে করে না।
আমি যখন নোয়া পাড়ার ওদিকে যাই তখন হোটেল আল-হেলাল ছিল। একটা কফি দোকার ছিল। আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে বলল- কফি খাবে? তখন আমার ভেতরটা কলঙ্কিত তখন আমি নিজের সাথে নিজেই দেখা করতে ভয় পেতাম। অন্ধকারের সাথে দেখা করতেও ভয় পেতাম, আলোর সাথেও দেখা করতে ভয় পেতাম। সবসময় আমার মধ্যে সংকোচ কাজ করত। পেছনে দাঁড়ানো ছাড়া আর সামনে দাঁড়াতাম না। এমনই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।

এরপর তারা হুইস্কি কুলি করে আমার মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। আর বলছিল- “she should co-operate us otherwise puts on dick on her private parts” এই উক্তিটা আমার এখনো মনে আছে। এই কথাটা বলার সাথে সাথে আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমি বললাম- প্লিজ তোমারা আমাকে একটা উপকার কর আমি তোমাদের কে সকল সহযোগিতা দেব শুধু তোমরা আমাকে হত্যা কর। আমি উর্দুতে একবার ইংরেজিতে একবার বলছিলাম প্লিজ আমাকে হত্যা কর। তোমাদের সকল সহযোগিতা করব। আমাকে রেপ কর আমার আপত্তি নেই তবে আমাকে হত্যা কর। তবু আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে যেও না। তারপরেও ক্যান্টনমেন্টে তারা আমাকে নিয়ে গেল"।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী নিজের স্মৃতিকথাতে জানান, সেসময় তার বাবার কলিগ অফিসার ভূঁইয়া হত্যায় তাকে সন্দেহ করছিল পাকিস্তানি সেনারা। এমনকি ঐ এলাকায় যেসকল হত্যা হচ্ছে সবগুলোর পরিকল্পনাও প্রিয়ভাষিণীই করছেন এমন ধারণা থেকেই তারা তাকে নয় মাস তাড়া করে বেড়ান, এমনকি তার কর্মস্থলেও নজরদারি শুরু করে। তার ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায়ও তাকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

পাকিস্তানি ক্যাম্পে নির্যাতন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই লড়াকু নারী বলেন, "প্রথম পর্যায়ে আমি দুই থেকে তিনজন অফিসার দ্বারা রেপ হয়েছি এবং আমি কিছু বলতে পারি নি। আমি যেন নির্বোধ একটা জীব জন্তুতে পরিণত হয়েছিলাম। এখানে আমার কোন শক্তিও ছিল না আমার কোন সাহসও ছিল না"।

অবশেষে মুক্তি ও ফিরে আসা
পরবর্তীতে এক মেজরের সহায়তায় সেই ক্যাম্প থেকে মুক্তি পান ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। কিন্তু সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসাটা কি খুব সহজ ছিল?

"পরিবার বলতে; আমার মা-ও একজন প্রগতিশীল মহিলা ছিলেন। বলা চলে তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কারণ তিনি ছোট্ট আকারে একটা হোম খুলে ছিলেন । মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। আমার মা আর তার বান্ধবী মিলে যশোরের রেল রোডে একটা বাড়িতে চিলে কোঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাস্তা দিতেন। তিনি তার ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আমার ভাই শিবলি কোন দিন বিয়ে করে নি সেও পূর্ণদ্যোমে মুক্তিযুদ্ধ যোগ দিল টেলিফোনে চাকরি করা কালীন। তখন একটা সুবিধা ছিল অনেক কমুনিকেশন তার ছিল। ফলে সে অনেক খবর আনতে পারব। ডিনামাইড আনা ও এগুলোতে লিড দেওয়ার মধ্যে আমার ভাই শিবলী একজন ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্টেও তার নাম আছে। যুদ্ধের বিষয়ে তারা ঠিক ছিল কিন্তু আমার বিষয়ে তারা একটু নড়ে গিয়েছিল যে; আমাকে বাসায় গ্রহণ করা যাবে না। খুব অবাধে বাড়িতে যেতে পারি নি আসলে। আমার নিজের মধ্যেও সংকোচ ছিল যে; আসলে আমি বিশাল কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কারো সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না যদিও আমার মা কোন কালেই এসব নিয়ে প্রশ্ন করেন নি"- বলেন প্রিয়ভাষিণী।

কিন্তু জীবনের এতো ক্লেদ, এতো নিষ্ঠুরতার পরেও উঠে দাঁড়িয়েছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। মানুষের কাছ থেকে এতো পাশবিক আচরণ পেয়েও ফিরে গেছেন আবারো মানুষের কাছেই, জীবনের কাছেই। তার জীবনের শত নিষ্ঠুর নির্মমতাই পরবর্তীতে তার জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে।  

পুরস্কার ও সম্মাননা
শিল্পকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে। এছাড়াও তিনি

হিরো বাই দ্যা রিডার ডাইজেস্ট ম্যাগাজিন (ডিসেম্বর ২০০৪);
চাদেরনাথ পদক;
অনন্য শীর্ষ পদক;
রৌপ্য জয়ন্তী পুরস্কার (ওয়াইডব্লিউসিএ);
মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। ৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ‘সুলতান স্বর্ণপদক’ পান ভাস্কর শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।

মৃত্যু
দীর্ঘদিন ধরে নানান শারীরিক জটিলতায় ভোগার পর ৬ মার্চ, ২০১৮, রোজ মঙ্গলবার, বেলা পৌনে ১টায় রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালের সিসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেছিলেন, "সকল বীরাঙ্গনা নারী জাতির পক্ষ থেকে বলব- যারা সে দিন নীরবে যুদ্ধ করেছেন, অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে, অসহায়ত্বের মধ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া উচিত"।

তার সেই দাবী, তার সেই লড়াই-ই পুনঃ পুনঃ উজ্জীবিত হয়ে উঠুক সকল জানা অজানা বীরাঙ্গনাদের কণ্ঠে।

তথ্যসূত্র:
১। "ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী"। গুণীজন।
২। নিন্দিত নন্দন- ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী
৩। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধশিশু প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কিছু কথা- মুক্তমনা ব্লগ
৪। "স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের তালিকা"। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। 
৫। ‘সুলতান স্বর্ণপদক’ পেলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী- জাগরণীয়া [bangla.jagoroniya.com/victress/13286/]
৬। চলে গেলেন প্রখ্যাত ভাস্কর-মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী- জাগরণীয়া [bangla.jagoroniya.com/culture/14304/]