লড়াকু নারী মনোরমা বসু
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:৪০ | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:০০
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে মনোরমা বসু কালের চক্রে, দিনবদলের পালায় চলে আসেন বরিশালে। তার নিজের কথায়, ‘১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হয়ে গেল। জন্ম নিল সম্রাজ্যবাদের কুচক্রের ফলে পাকিস্তান। কী রকম দিশেহারা হয়ে পড়লাম। এর নাম স্বাধীনতা? সমস্ত মনপ্রাণ নিয়ে কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম? ১৯৪৭-এ কলকাতায় পার্টি মিটিং ডাকা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আঞ্চলিক কমিটি গঠন করে স্থানীয় কমরেডদের সেই স্থানে কাজ করতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত করি পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করব।’
১৯৪৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মনোরমা বসু কলকাতায় ছিলেন। এই সময় যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মেয়ে বাসনার মৃত্যু হয়। এর মধ্যে মে মাসে মনোরমা বসুর কাছে ঢাকা থেকে টেলিগ্রাম যায়। ঢাকায় প্রাদেশিক মহিলা সম্মেলন হবে, তার প্রস্তুতির জন্য উপস্থিত থাকতে বলা হয় তাকে। মনোরমা বসু ঠিক করলেন, দেশে নিজ ঘরে বরিশালেই যাবেন। মেয়ে মারা গেছে মাত্র তিন দনি, তবুও তিনি রওনা হলেন। প্রাণের তাগিদেই তিনি জড়িয়ে পড়লেন সংগঠনে।
আলোচনার টেবিলে ‘মোয়া ভাগের স্বাধীনতা’ যে মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, তারই উদাহরণ একের পর এক দেখা গেলো পূর্ব পাকিস্তানে। পার্টির সিদ্ধান্তে ৫ জুন কালেক্টরিতে ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে। মনোরমা বসুসহ দলে দলে ছেলে-মেয়েরা মিছিলে যান। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট দেখা না করে মনোরমা বসু আর তার সহযোদ্ধা বিভাকে ভেতরে দেখা করতে বলেন। এতে সব মেয়ে বাধা দেন। তখন পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। এ কথা পৌঁছে যায় বিএম কলেজে, সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রনেতা স্বদেশ বোসসহ ছাত্ররা চলে আসেন ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে। উকিলরাও মনোরমা বসুদের প্রতিবাদকে সমর্থন করেন। কিন্তু হঠাৎ করেই পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। প্রচন্ড মারধর করে কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভেতর থেকে বেড় হয়ে আসেন মনোরমা বসু। সঙ্গে সঙ্গে মনোরমা বসুসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মনোরমা বসুকে বরিশালে জেলে পাঠানো হলো। দশ মাস হাজতবাস ও এক বছর সাজা। ছেড়ে দিয়েই আবার নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হলো তাকে। জেল হলো চার বছরের। তার মেয়ে ভজনাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তারও চার বছরের জেল হয়। শেষ দুই বছর মনোরমা বসু ছিলেন রাজশাহী জেলে। তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের সঙ্গে জেলে ছিল নলিনী দাস, ইলা মিত্র, ভানু চ্যাটার্জি, অপর্ণা, অমিত, সুজাতা দাসগুপ্ত। চার বছর পর ১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল ছাড়া পেয়ে বরিশালে ফিরে আসি।’
জেলে বসেও তিনি সংগঠন গড়েছেন, নানা কাজে মাতিয়ে রেখেছেন সহবন্দিদের; আর একের পর এক লিখেছেন কবিতা। জেলে বসে শিক্ষা, নারী অধিকারের শিক্ষ, অধিকার আদায়ের শিক্ষা; চলত নানা রকম হাতের কাজের শিক্ষা। রাজশাহীর আগে মনোরমা বসু কিছুদিন কাটিয়েছেন সিলেট জেলে। সিলেট জেলে সহবন্দিদের মধ্যে ছিলেন অপর্ণা পাল চৌধুরী, অমিতা পাল চৌধুরী, সুষমা দে প্রমুখ।
১৯৫৪ সাল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে সারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির দেড় মাসের মাথায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা, পরের বছর ১৯৫৩-এর জানুয়ারি মসে হাজী মোহম্মদ দানেশের নেতৃত্বে গণতন্ত্রী দলের আত্মপ্রকাশ, একই বছর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনে মনোরমা বসু ছিলেন সোচ্চার।
প্রদেশব্যাপী আবার শুরু হয় ধরপাকড়। অন্য অনেকের সঙ্গে মনোরমা বসুর নামেও জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। একটানা চার বছর জেবাসের পর ২৫ এপ্রিল ১৯৫২ রাজশাহী জেল থেকে মুক্ত হন। মেয়ে ভজনা মুক্তি পান অক্টোবর মাসে। বরিশালে ফিরে গিয়ে আবার সাংগঠনিক কাজে তৎপর হয়ে পড়েন তিনি। তবে কারাবাসের সময় মাসিমা (মনোরমা বসু) সংগঠন গড়েছেন, কয়েদিদের জন্য পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছেন। আর তিনি কবি হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন।
মনোরমা বসুর জন্ম ১৮ নভেম্বর (১ অগ্রাহায়ন ১৩০৪) বরিশাল জেলার বানারীপাড়া থানার নরোত্তম গ্রামে। বাবা নীলকণ্ঠ রায়। জমিদারগিন্নি মনোরমা বসু মানবসেবায় সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। আর তাই তিনি মনোরমাদি থেকে ধীরে ধীরে মনোরমা মাসিমা হয়ে উঠেছেন।
১০ মে ১৯৫৪ মাসিমার জীবনের মর্মান্তিক ঘটনা, স্বামীর মৃত্যু। যিনি না থাকলে মাসিমা হয়তো আজ সবার মাসিমা হতে পারতেন না, ‘কোন এক গাঁয়ের বধু’ হয়েই হয়তো থকতেন। এরই মধ্যে মাসিমার নামে আবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। শুরু হয় পলাতক জীবন। ১৯৫৬ সালে পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হলে আবার বরিশালে ফিরে আসেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে আত্মনিয়োগ করেন মাতৃমন্দির, মুকুল-মিলন খেলাঘর আর পল্লি উন্নয়ন অমৃত পাঠাগার প্রতিষ্ঠায়। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হলে তিনি বেশ স্বস্তি পান। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আবার সংগঠনের কাজে যোগ দেন। এরই মধ্যে পার্টির কমিউন হিসেবে মাতৃমন্দিরে দায়িত্বপালন শুরু করেন। নলিনী দাস, মুকুল সেনসহ বেস কয়েকজন পার্টি-নেতার দেখাশোনার ভার গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় দুর্ভিক্ষপীড়িতদের পাশে দাঁড়ান মাসিমা। এরই মধ্যে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সম্মেলনে যোগ দিতে আন্দামান যান তিনি। সোভিয়েত নারী কমিটির আহ্বানে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। ১৯৮০ সালের পরের দিনগুলো তার কখনো মেয়ের বাড়ি, কখনো নিজের বাড়িতেই কেটেছে।
১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি পরলোক গমন করেন বরিশালের মাতৃমন্দিরে। মনোরমা বসু শেরে বাংলা পদক, বেগম রোকেয়া পদকসহ আরো অনেক পদকে ভূষিত হয়েছেন। সংগ্রামী জীবনের এই নারী আজ অনেকের কাছেই অপরিচিত। তবে তিনি কখনোই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। জন্ম থেকে জন্মান্তর বেঁচে থাকবেন সবার মাসিমা হয়েই।
তথ্যসূত্র: বায়ান্নর ৫২ নারী, সুপা সাদিয়া