বাংলাভাষার যোদ্ধা সুফিয়া আহমদ
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:২৪ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:২৯
‘১৯৪৮ সালে যখন ভাষাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিতর্কের সূত্রপাত হয়, আমার বাবা তখন বরিশালের জেলা জজ ছিলেন এবং আমি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আইএ পড়ি। বাবা এ সময় বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার ঔচিত্যের কারণ এবং তা না হলে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ তথা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে তার নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন। বাবা সাধারণত তার ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের খসড়া আমাকে দিয়েই তৈরি করাতেন। আর এ কাজের ভিতর দিয়ে অজান্তেই বাংলা ভাষার প্রতি আমার অনুরাগ বৃদ্ধি পায়।
ভাষা আন্দোলনে আমার অংশগ্রহণ কোনো আকস্মিক বা নিছক আবেগতাড়িত ঘটনা ছিল না। মাতৃভাষার মর্যাদা ও বাঙালি জাতির স্বকীয়তা ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে নিজের বিবেকের তাড়নায়ই ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। এর পেছনে কোন রাজনৈতিক বা দলীয় কারণ ছিল না।’
১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এবং ২২ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন সভায় মোহম্মদ আলী জিন্নাহ বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার রাষ্ট্রভাষা-সম্পর্কিত অংশটি অনেককেই আহত করে। এরই মধ্যে ১৯৫০ সালে সুফিয়া আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ছাত্রীনিবাসে না থাকলেও জড়িত ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন তার ভাষণে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। এতে মানুষের মনে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় যে ক্ষোভ এত দিন জমাটবদ্ধ ছিল তা প্রচন্ড দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। এই বিক্ষোভে আন্দোলিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুফিয়া আহমদ।
বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করুক-এই দাবিতে সব সময়ই একাত্মতা প্রকাশ করেন সুফিয়া আহমদ। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সংগঠন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। তাদের অনুপ্রেরণায় সুফিয়া আহমদ সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যেসব মিছিল ও সমাবেস অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোতে যোগ দিয়েছেন এবং অনেক সময় বক্তৃতাও করেছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রজনতার সমাবেশে সুফিয়া আহমদ উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তে হলে মেয়েদের যে দলটিপ্রথম বের হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে, সুফিয়া আহমদ সে দলে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। ছাত্রীদের প্রথম যে দলটি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য এগিয়ে যায় তাদের মধ্যে ছিলেন শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার আর সুফিয়া আহমদ। বিশ্ববিদালয় গেটের সামনে পুলিশের লাঠির ব্যারিকেড দেওয়া ছিল। তাদের দল কিছুটা সামনে যেতেই ঢাকা সিটির এসপি মাসুদ মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয় সুফিয়া আহমদের। তিনি সুফিয়া আহমদকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন, কারণ তৎকালীন হাইকোর্টের জজ ছিলেন সুফিয়া আহমদের বাবা। এসপি মাসুদ মাহমুদ বলেন, ‘প্রসেশনে আসাটা তোমার ভুল হয়েছে। সরকার বিক্ষোভকারীদের কঠোর হস্তে দমন করার নির্দেশ দিয়েছে আমাদের। তুমি বাসায় চলে যাও। তা না হলে তোমাদের বিপদ হতে পাতে।’ তবু সুফিয়া আহমদ তার দলের সঙ্গে ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যান। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে এবং লাঠিপেটা শুরু করে। পুলিশের লাঠির আঘাতে সুফিয়া আহমদ আহত হন। সেদিন বিকেলে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্য আনোয়ারা খাতুনের বক্তৃতায় সুফিয়া আহমেদের ওপর পুলিশের হামলার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ পায়।
এরই মধ্যে সুফিয়া আহমেদের বাড়িতে তার আহত হওয়ার খবর পৌঁছে যায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মেডিক্যাল কলেজে ব্যস্ত সময় কাটানোর পর সন্ধায় ফিরে যান বাড়িতে। তার বাবা-মা তার উপর রাগ না করে এই অংশগ্রহণের জন্য মেয়েকে আশীর্বাদ করেছিলেন। ওই দিনের পর থেকে তার ভাষা আন্দোলনে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা। ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়।
সুফিয়া আহমদ, সাংবাদিক লায়লা সামাদসহ বেশ কয়েকজন নারী ভাষা আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজ করেছেন। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলেছেন। এভাবে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কাজে তিনি আত্মনিবেদন করেছেন।
তিনি ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে ১০ সদস্যের একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে তুরস্ক যান। সেই দলে ছিলেন কবি জসিমউদদীন, শামসুন নাহার মাহমুদ, লায়লা আরজুমান্দ বানুসহ আরো বেশ কয়েকজন। দলের নেতা ছিলেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য প্রফেসর এ বি এ হালিম। এই অনুষ্ঠানে দলটি উর্দু গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তখন বাংলা গান গাইতে চাইলে দলের নেতা অমত প্রকাশ করেন। বাংলা গান গাওয়ার দাবিতে দলটি অনুষ্ঠান বর্জন করে। অবশেষে বাংলা গান গাওয়ার অনুমতি লাভ করেন তারা।
সুফিয়া আহমদ ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপচার্য, বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী মোহাম্মদ ইব্রাহীম মেয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই মানুষ করেছেন। সুফিয়া আহমদের আমা লুৎফুন্নেছা ইব্রাহীম। বাবা-মা আর দুই ভাইকে নিয়েই সুফিয়া আহমদের ছোটবেলার জগৎ গড়ে উঠেছিল। ‘ছোটবেলায় একবার হাম কি পক্স হয়েছিল ঠিক মনে নেই। আমার দেখাশোনার জন্য বাবা একজন খ্রিষ্টান নার্স রাখলেন। গায়ে মাখন লাগালে দাগ হয় না। আব্বা সেজন্য প্রতিদিন আমার গায়ে ঠিকমতো মাখন লাগানো হচ্ছে কি না, তার তদারকি করতেন।’ এভাবেই নিজের শৈশবকালের গল্প শোনালেন তিনি।
নাচ, গান, সেলাই, রান্না, রূপচর্চা প্রভৃতিতে ভারা ছিল সুফিয়া আহমদের ছোটবেলাটা। ধ্রুপদী সংগীত শখতেন ওস্তাদ গুল মোহাম্মদের কাছে, সেলাই সেখানোর জন্য আসতেন এক মিস, রান্না শেখার জন্য হোসনে আরা রশীদের পাক প্রণালী বই আর রূপচর্চার জন্য অন্য একটি বই তার বাবা তাকে কিনে দেন। প্রতিদিন একটি করে চিঠি পাওয়ার শর্তে দার্জিলিংয়ে পড়তে যাওয়া সুফিয়া আহমদের শিক্ষাজীবন নানা বর্ণে রঙিন ও গৌরবোজ্জ্বল। বিচারপতি বাবার বদলির চাকরি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভালো ইংরেজি স্কুল না থাকায় তার শৈশবের বেশ কিছুটা দিন অবিভক্ত ভারতের দার্জিলিংয়ে কেটেছে। আর সেখানেই শিখেছেন পিয়ানো। তবে শিক্ষাজীবনের প্রথমটা শুরু হয় ঢাকার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এর পর চলে যান দার্জিলিংয়ের ডাও হিল (Dow Hill) স্কুলে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ক্রমেই দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। তাই সুফিয়া আহমদ চলে আসেন নিজ দেশে। এরপর ১৯৪৮ সালে বিচারপতি বাবার কর্মস্থল বরিশাল থেকে প্রাইভেট প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর তার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পথচলা। পূর্বপাকিস্তান থেকে ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টস (Intermediate if Arts) পরীক্ষা দেন। এই পরীক্ষার ফলে দেখা গেল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে প্রথম ১০ জনের মধ্যে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন তিনি।
সুফিয়া আহমেদের অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান অথবা ইংরেজিতে অনার্স করার ইচ্ছা ছিল। বাবার ইচ্ছেমতেই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইংরেজিকে সাবসিডিয়ারি করে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হন। তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন ছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ সালে এমএ পড়ার সময় তিনি সন্ধাকালীন আইনের ক্লাসে ভর্তি হন। এমএ পরীক্ষার অল্প কিছুদিন পরেই ১৯৫৫ সালে পিএইচডি করতে তিনি স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ ও ছোট ভাই খালেদ ইব্রাহীমের সঙ্গে লন্ডনে চলে যান। ফলে ল কোর্স শেষ করেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় বসতে পারেন নি। তার পিএইচডির বিষয় ছিল-আধুনিক ভারতের ইতিহাস। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (School of Oriental and African Studies) ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে তিনি 'Some Aspects of the History of The Muslim Community in Bengal' (১৮৮৪-১৯১২) শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি লাভ করেন।
১৯৬১ সালে তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি এই বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। দেশের বাইরেও সুফিয়া আহমদ একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অধ্যাপক সুফিয়া আহমদ অধ্যাপনাও করেছেন। তুরস্কের ইন্তাম্বুল শহরে অবস্থিত ব্যাসফোরাস ইউনিভার্সিটিতে (Basphorus University) তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেন।
সম্ভবত তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি দুই বার জাতিসংঘে কোনো দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমবার ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের এবং দ্বিতীয়বার ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের হয়ে। এরপর প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে ১৯৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগাযোগ করেন। সুফিয়া আহমদ জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা ছাড়াও ১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত গার্লস গাইড আন্দোলনের নির্বাচিত আন্তর্জাতিক কমিশনার ছিলেন।
সমাজসেবামূলক কাজেও এই নারী ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করে চলেছেন সমানভাবেই। গুরুত্বপূর্ণ পদ সামাল দিয়ে কঠোর পরিশ্রমী এক নারী আইসিডিডিআরবির ‘অ্যাথিক্যাল রিভিউ কমিটি’র মেম্বর হিসেবে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত।
তিনি প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ ইশতিহাক আহমদের স্ত্রী।
সুফিয়া আহমদ জাতীয় অধ্যাপক পদে ভূষিত হন। তিনি নারীদের মধ্যে প্রথম জাতীয় অধ্যাপক।
তথ্যসূত্র: বায়ান্নর ৫২ নারী, সুপা সাদিয়া