যশোরে ভাষা আন্দোলনের সেনানী হামিদা রহমান
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:১১
১৯৪৭-৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে হামিদা রহমান দলীয় পরিচয়ের বাইরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৪৭ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় যখন লেখালেখি চলছিল, সে সময় তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত স্বাধীনতা পত্রিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে একটি পত্র লেখেন। ১০ জুলাই ১৯৪৭-এর সংখ্যায় স্বাধীনতা পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে চিঠিটি প্রকাশিত হয়।
যশোরে ভাষা আন্দোলন সংগঠন ও পরিচালনায় সেখানকার নারীনেত্রী মিসেস হামিদা রহমানের অসামান্য আবদানের কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে কাজী আবদুর রউফ যশোরে ভাষা আন্দোলন সংগঠনে সক্রিয় হন। তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এগিয়ে আসেন নারীনেত্রী হামিদা রহমান। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ‘তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব কমিটি’ নামে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আলমগীর সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে যশোরে ওই সংগ্রাম পরিষদের শাখা গঠিত হয় এবং যুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটিতে হামিদা রহমান সদস্য হিসেবে মনোনীন হন।
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালিত হয় এবং এ সময় যশোরে ওই কর্মসূচি সফল করার জন্য অন্যদের সঙ্গে নারীনেত্রী হামিদা রহমান অগ্রগামী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। সেদিনের হরতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের কর্মসূচির প্রতি যশোরের মোমিন গালর্স স্কুলের শিক্ষকেরা একমত না হওয়ায় স্কুলের গেট বন্ধ করে ক্লাস চালু রাখা হয়েছিল। এ খবর পাওয়ার পর হামিদা রহমানের নেতৃত্বে মেয়েদের একটি মিছিল মোমিন গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে সমবেত হয়। তিনি ও তার সাথিরা লাথি মেরে স্কুলের গেট খুলে ফেলেন। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রী মোমিন গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনি দিয়ে শুরু করেন। উল্লেখ্য, ম্যাজিস্ট্রেট নোমানী যশোরে ১১ মার্চ ১৪৪ ধারা জারি করেছিলেন।
হামিদা রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রী-মিছিলটি মোমিন গার্লস স্কুল থেকে যশোর কালেক্টরেটের সামনে এসে হারি হয়। এ সময় কোর্টের সামনে দাড়িয়ে হামিদা রহমান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এক পর্যায়ে পুলিশ ওই ছাত্রীসমাবেশে বাধা দিতে এগিয়ে আসে। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা পুলিশকে প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টা চালান। এ সময় পুলিশ লাঠিপেটা করে এবং গুলি চালায়। এতে অনেক আহত হলেও কেউ মারা যাননি। হামিদা রহমান আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন। কিন্তু পুলিশ সুফিয়া নামে একজনকে হামিদা রহমান ভেভে ধরে নিয়ে যায়।
১১ মার্চ রাতে যশোর কলেজের ছাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের গোপন বৈঠক বসে। হামিদা রহমান ছেলেদের পোশাক পরে সে বৈঠকে যোগ দেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য যশোরে ধর্মঘট চালানো হবে। ধর্মঘট একটানা সতদিন চলে এবং সাধারণ মানুষ তাতে ব্যাপক সাড়া দেয়। উপরোক্ত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ধর্মঘট চলার পাশাপাশি ১৩ মার্চ যশোরে হরতাল পালিত হয়। হরতাল কর্মসূচি চলাকালীন সেদিন হামিদা রহমানের নেতৃত্বে যশোরে মেয়েদের একটি মিছিল বের হয়।
মিছিলটি সংগঠিত করতে তাকে সাহায্য করেন রুবি আহমদ ও সুফিয়া খাতুন। মিছিলটি মোমিন গার্লস স্কুলের সামনে থেকে যাত্র শুরু করে বার লাইব্রেরির সামনে দিয়ে চৌরাস্তা হয়ে কালেক্টরেটর ভবনের দিকে এগিয়ে যায়। এ সময়ে মেয়েদের মিছিলের পাশাপাশি ছেলেদের আরেকটি বিশাল মিছিলও এখানে এসে সমবেত হয়।
এক পর্যায়ে মিছিলের ছাত্র-জনতা কালেক্টরেট ভবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন কোতয়ালি থানার ওসি আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল মিছিলটি প্রতিরোধ করে ভবনে ঢুকতে বাধা দেয়। কিন্তু মিলিছকারীরা সামনে এগোতে চেষ্টা করেন।
এরপর শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে মেয়েরা সেই সংর্ঘষে অংশ নেন। জনতার সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলার মধ্যে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলে। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও ছাত্র আহত হন। এক সময় ওসি আবদুল জব্বারের কানে একটি ইটের আঘাত লাগে। তার কান ছিঁড়ে লক্ত ঝরতে থাকে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করে। ছাত্র নেতা আলমগীর ছিদ্দীকি এ সময় গুলিবিদ্ধ হন। হামিদা রহমান এবারও রক্ষা পান।
পুলিশ হামিদা রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। তাকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে বিভিন্ন থানায় তার নামে ওয়ারেন্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি থেকে তাকে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি আত্মসমর্পণ না করে আত্মগোপন করেন এবং পার্টির কার্ড ফেরত দেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে হামিদা রহমান প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারেননি।
সমাজসচেতন সাহিত্যিক হামিদা রহমান ১৯২৭ সালের ২৯ জুলাই যশোর শহরের পুরোনো কসবায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ বজলুর রহমান এবং মায়ের নাম বেগম লুৎফুন্নেছা। ১৯৪২ সালে নোয়াখালী নিবাসী সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
১৯৪২ সালে হামিদা রহমান তারাপ্রসন্ন বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৭ সালে মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনিয়মিত পরীক্ষা দিয়ে বিএ এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাশ করেন। ১৯৬৮ সালে লালমাটিয়া গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার শিক্ষকতা জীবনের শুরু। পরবর্তী সময়ে তিনি জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। কলেজটি জাতীয়করণ হলে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পুরানা পল্টন গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে কলেজের চাকরি ছেড়ে তিনি সাহিত্যসাধনা ও সাংবাদিকতা শুরু করেন।
স্কুল ম্যাগাজিনে তার লেখার মধ্য দিয়েই হামিদা রহমানের সাহিত্যচর্চার সূচনা। কলেজ ম্যাগাজিনে তার লেখা ‘সর্বহারা’ ও ‘রিকসাওয়ালা’ শীর্ষক ছোটগল্প দুটি প্রকাশিত হলে সুধীসমাজে লেখিকা হিসেবে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যশোর থেকে প্রকাশিত আল মোমিন পত্রিকার তিনি মহিলা বিভাগের সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করতেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত নববানী মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ষাট ও সত্তরের দশকে ইত্তেফাক পত্রিকার মহিলা বিভাগে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ‘বিলকিস বেগম’ ছদ্মনামে লেখা তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সাহিত্যিক হামিদা রহমান দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বেগম, দৈনিক আজাদ, সংবাদ, পূর্বাণী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য পত্রিকার সঙ্গে লেখক হিসেবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার দুই ভাই শহীদ হন। ১৯৭১ সালে দৈনিক আজাদ পৈত্রিকায় স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদদের সম্পর্কে তার গুরুপ্তপূর্ণ তথ্যভিত্তিক একটি লেখা প্রকাশিত হয়।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনে অবস্থান করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে হামিদা রহমান সেখানে দুটি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেখানে উইমেন্স অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের মেম্বর ছিলেন। হাউস অব লর্ডস এবং হাউস অব কমেন্স হামিদা রহমান বক্তৃতা দেওয়ার দুলর্ভ সম্মান লাভ করেন।
সমাজসেবা এবং নারীমুক্তি আন্দোলনে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা স্মরণযোগ্য। যশোরে পুরোনো কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাসহ তিনি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ নারী আন্দোলন সংসদের তিনি সভানেত্রী এবং কার্যকরী সদস্য। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ এবং বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য তিনি। তিনি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সহসভাপতি ছিলেন।
২০০৫ সালের ১৪ আগষ্ট বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে ৭৮ বছর বয়সে তিনি ঢাকার নিজ বাসভবনে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: বায়ান্নর ৫২ নারী, সুপা সাদিয়া