ভাষা সংগ্রামী জুলেখা হক
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:২৬ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:০৯
‘১৯৫২ সালের প্রথম থেকেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ ক্রমে জোরদার হয়ে উঠেছিলো, তার প্রভাব আমাদের মতো কিশোরীদের ওপরও যথেষ্টভাবে পড়েছিল। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়, তখন আমরা একযোগে স্কুলগেটে পিকেটিং করি, নিচের ক্লাসের মেয়েদের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে সেদিনের স্কুলের সাধারণ কর্মকান্ড বন্ধ করে দেই।’ এ কথাগুলো বলেন জুলেখা হক।
জুলেখা হক আরো বলেন, ‘দুপুরে বেশ বড় মিছিল করে আমাদের স্কুল ও মুসলিম গার্লস স্কুলের (নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত তৎকালীন দ্বিতীয় বৃহৎ ছাত্রী বিদ্যালয়) ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশাল সভায় একত্রিত হই। সেদিনকার বিভিন্ন বক্তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা আমাদের ভীষণ উদ্বুদ্ধ করে। তখনই শুনি, ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে আরো বড় প্রতিবাদ হবে এবং প্রাদেশিক অ্যাসেমব্লিতে সাংসদদের সামনে বিক্ষোভ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আপারা-হালিমা আপা, শাফিয়া আপা, প্রতিবাদি আমাদের মতো স্কুলছাত্রীদের হরতাল সফল করার জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।’
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় জুলেখা হক ঢাকার হাটখোলার সরকারি কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রীনেত্রী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একাত্বতা প্রকাশের জন্য কামরুন্নেসা স্কুলের জন্য ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করতে স্কুলটিতে যান। তারা সেখানকার শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন বাংলা ভাষাকে রক্ষার দাবিতে যে আন্দোলন তাতে সক্রিয় হওয়ার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের দু’জন নেত্রী শাফিয়া খাতুন ও হালিমা খাতুনের সাহচর্যে জুলেখা হক ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হন। নিজেকে ভাষা আন্দোলনের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বেশ কয়েকটি সমাবেশে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া এসব সমাবেশ ও মিছিলকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করার নানা রকম তৎপরতা চালিয়েছেন তিনি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলে ছাত্রীদের বেশ কয়েকটি সভা-সমাবেশ হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে। এসব সমাবেশ সংগঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং বক্তৃতা দেন। সে সময় সমাবেশগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক ছাত্রীনেত্রী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখার জন্য আসতেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। বেলা ১১টার দিকে জুলেখা হকসহ অর্ধশতাধিক মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তারা তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সমাবেত হন। তখন এর চারিদিকে রাস্তা পুলিশের গাড়ি ও সেনাবাহিনীতে ভর্তি। দুপুর ১২টার দিকে শুরু হয় সভা। ছাত্রনেতারা তখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত।
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন সবাই-১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-জনতার সমাবেশে জুলেখা হক তার স্কুলের ছাত্রীদের মিছিল সহযোগে অংশ নেন।
এ সময় জুলেখা হকের বাবাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অধ্যাপকরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারন তারা নুরুল আমীন সরকারের কঠোর মনোভাবের কথা জানতেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালের এই আন্দোলনে সরকারের সঙ্গে প্রথম সংঘর্ষ হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। অধ্যাপকরা মূলত তাদের শিক্ষার্থীদের এই মারদাঙ্গার হাত থেকে বাঁচাতেই নিষেধ করেছিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙতে।
কিন্তু এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য জুলেখা হক একটি দলের সঙ্গে রাজপথে নেমে আসেন। এক পর্যায়ে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের প্রবল চাপে পড়তে হয় তাকে। তবু তিনি পিছু হটেননি। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের মুখেও তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পিকেটিং করেন।
‘ছাত্ররা কী এমন চেয়েছিল! বর্তমান জগন্নাথ হল এলাকায় অবস্থিত প্রাদেশিক অ্যাসেমব্লির সদস্যদের হাতে প্রতিবাদলিপি তুলে দেবে। এই তো? তার জন্য এমন নৃশংস হত্যাকান্ড! কিন্তু আমরা তখন ছোট। সমস্ত পরিবেশ এমন আতঙ্কময়, তখন বড় ছাত্ররা ও আপার আমাদের কোনরকমে হাসপাতালের ভেতর দিয়ে নিয়ে হোস্টেল এলাকায় কিছুক্ষণ রেখে বাড়ি পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু সেই গল্প সময়েই হাসপাতালে রক্তাক্ত মৃতপ্রায় বেশ কয়েকজনকে দেখে আমাদের যে ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা হয়েছিল, তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
সেই দিনের সেই অভিজ্ঞতা, সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে যে ঘৃণার জন্ম দেয়, তা সারা জীবন আমাকে দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মমতায় পরিপূর্ণ করে রেখেছে। বয়স খুব কম হলেও সেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক মুহূর্তে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম বলে আমি অত্যন্ত গর্বিত ও কৃতার্থ।’ বায়ান্নর সেই অগ্নিঝরা দিনের কথা খুব সাদামাটাভাবেই বর্ণনা করেন জুলেখা হক।
১৯৫৩ সালে সরকারি কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলে ছাত্রীদের উদ্যোগে জুলেখা হকের নেতৃত্বে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। কোন স্কুলে প্রতিষ্ঠিত এটিই প্রথম শহীদ মিনার, যা জুলেখা হককে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে।
তথ্যসূত্র: বায়ান্নর ৫২ নারী, সুপা সাদিয়া