ভাষা সৈনিক আনোয়ারা খাতুন
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:০৫ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:০৯
ভাষা সৈনিক আনোয়ারা খাতুন ভাষা আন্দোলনের গতি নির্ধারণে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালে আন্দোলনের বেশ কয়েকটি গোপন আলোচনা-বৈঠক তার ঢাকাস্থ ২৩ নম্বর গ্রিন রোডের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের পুরোধা অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং আন্দোলনের সূচনাকারী সংগঠক তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এই দলের সঙ্গে যুক্ত হন। আইন পরিষদের সদস্য হিসিবে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আইনসভার ভেতরে ও বাইরে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন।
২ মার্চ ১৯৪৮ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ‘তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি’ গঠনকল্পে যে বৈঠক হয়, আনোয়ারা খাতুন সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী হরতার পালিত হয়। তিনি সে সময় আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের রাজপথের আন্দোলনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সভায় আনোয়ারা খাতুন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্ববায়ক করে যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, আনোয়ারা খাতুন সে কমিটিতেও অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে আনোয়ারা খাতুন রাজপথে ছিলেন সোচ্চার। তিনি এ সময় আইনসভায়ও তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। আইন পরিষদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন:
"নুরুল আমীন সাহেব যে কথা বললেন, নাজিমুদ্দিন সাহেব, তখনকার পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী, এ রকমই একটা কথা বলেছিলেন। আজ চার বছর পরে তিনিই আবার পল্টন ময়দানে বললেন, Urdu Shal be the only State Language. এ থেকে মনে হয় যে, নাজিমুদ্দীন সাহেব তিন বছর আগে যে আশ্বাস দিয়েছিলেন সেটা একটা bluff (ধাপ্পাবাজি) ছাড়া আর কিছু নয়। ...ঘটনা থেকে এ মনে হয়, আজও আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাইনি। তার প্রমান পুলিশের এ জুলুম। এ অত্যাচার থেকে মেয়েরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি- ছেলেদের কথা আর নাই বা বললাম। যে জাতি মতৃজাতির সম্মান দিতে জানে না, সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য।
.....পুলিশের লাঠিচার্জে মেয়েরা আহত হয়েছে। আমি তাদের মধ্যে দু’জনের নাম উল্লেখ করছি। একজন হলো ঢাকা হাইকোর্টের জাস্টিস ইব্রাহিম সাহেবের মেয়ে সুফিয়া ইব্রাহামি; আর একজন হলো রওশন আরা, থার্ড ইয়ার বিএ। মেয়েদের মোট আহতের সংখ্যা ৮ জন। মন্ত্রিসভা এমন একটা আবহের সৃষ্টি করেছে, যাতে মেয়েরা পর্যন্ত লাঞ্ছিত হয়েছে। এসমস্ত ঘটনা যে আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা চিন্তা করে বুঝে উঠতে পারছি না"। (সূত্র: East Pakistan Legislativ Assembly Proceedings, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
আইনপরিষদের এই অধিবেশনে আনোয়ারা খাতুন কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। প্রস্তাবগুলো হলো:
(১) ভাষা আন্দোলন-সূত্রে বন্দিদের শর্তহীন মুক্তি
(২) হতাহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান
(৩) হত্যা, নির্যাতন ও অপকর্মের জন্য দায়ী অফিসারদের প্রকাশ্যে বিচার করা এবং
(৪) সরকার কর্তৃক অন্যদের ওপর নির্যাতনের নীতি বন্ধ করা।
ভাষা আন্দোলনের চরম পর্যায়ে দেশে যখন উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন ২৩ ফেব্রুয়ারি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাসভবনে সিভিল লিবার্টি কমিটি গঠন করা হয়। আনোয়ারা খাতুন এই কমিটির পক্ষ থেকে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন প্রতিনিধিদলকে সাক্ষাৎকারের সময় না দেওয়ায় কোনো আলোচনা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, আনোয়ারা খাতুন ১৯১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুর রহিম। আনোয়ারা খাতুন ১৯৪৬ সালে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লির সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও তিনি এমএলএ হন। আনোয়ারা খাতুন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ) কেন্দ্রীয় পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আওয়ামী লীগের বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও আলোচনা তার বাসভবনে অনুষ্ঠিত হতো। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন।
১৯৮৮ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকার গ্রিন রোডের তার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র: বায়ান্নর ৫২ নারী, সুপা সাদিয়া