মৈত্রেয়ী দেবী: এক অমর বইয়ের অবিনশ্বর স্রষ্টা

প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:৫৩ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০১:১৩

"ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে" অর্থাৎ "শরীরকে হনন করা গেলেও একে হত্যা করা যায় না"। সে ঠিকই রয়ে যায়। সময় বা পরিস্থিতি হয়ত ক্ষণিকের জন্য তার উপর প্রলেপ দিতে পারে কিন্তু দেহস্থিত সেই সত্য অমর। কিন্তু কী সেই বস্তু যা রয়ে যায়- ধর্মীয় রক্ষণশীলদের কাছে যা আত্মা, সত্যান্বেষীদের কাছে সেটাই সত্য, অনুসন্ধিৎসুকের চোখে সেটাই জ্ঞান। আর সেই সত্যকে ধারণ করে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয় এক অসামান্য উপন্যাস ‘ন হন্যতে’। আর আত্মজীবনীমূলক এই গ্রন্থের শিল্পকার মৈত্রেয়ী দেবী।

জন্ম
১৯১৪ সালে ১ সেপ্টেম্বর ইংরেজ শাসিত বাংলার চট্টগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন মৈত্রেয়ী দেবী। পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত একজন দার্শনিক এবং প্রবন্ধকার আর মা হিমানী মাধুরী রায়। যদিও তার শৈশব কাটে বরিশালে, পিতার আদিনিবাস বরিশালের আগৈলঝারা গ্রামে। পরে পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে কৈশোরেই সপরিবারে চলে আসেন কলকাতার ভবানীপুরে। একদিকে পিতার আদর্শ আর অন্যদিকে তৎকালীন কলকাতার 'এলিট' সম্প্রদায়ের সাহচর্য, মৈত্রেয়ী দেবীর মননে আনে দার্শনিকতার ছাপ। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।

পারিবারিক জীবন
মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৩৪ সালে কলকাতার ড. মনমোহন সেনের সাথে বিয়ে হয়ে যায় মৈত্রেয়ী দেবীর। দুটি সন্তানের জনক জননী হন এই দম্পতি। কাজের সূত্রে হিমালয় ঘেঁষা দার্জিলিং এর মংপুতে থাকতেন এই দম্পতি। মংপুতে সিনকোনা চাষের গবেষণায় ড. মনমোহন সেনের বিশেষ অবদান ছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্য আর স্নেহে লালিত মৈত্রেয়ী দেবী কবিগুরুকে আমন্ত্রণ জানান মংপুতে বেড়িয়ে যাবার জন্য। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে চারবার অবকাশ যাপনের জন্য মংপুতে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

সাহিত্য জীবন
মাত্র ষোল বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উদারতা’ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকা স্বচ্ছন্দে লিখে দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তছায়া’। মংপুতে কবিগুরুর থাকাকালীন সময়ে কবিগুরুর সাথে তার অন্তরঙ্গ কথোপকথন নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর অনবদ্য গ্রন্থ ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত এ গ্রন্থটি ‘টেগোর বাই ফায়ারসাইড’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। রবীন্দ্র বিষয়ক তার অন্যান্য বইগুলো হল ‘স্বর্গের কাছাকাছি’, ‘কবি সার্বভৌম’, ‘রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: দি ম্যান বিহাইন্ড হিজ পোয়েট্রি’। 

তবে মৈত্রেয়ী দেবীর জীবনে আলোড়ন তুলেছিল অন্য একটি ঘটনা। 

১৯২৮-৩২ সালে ভারতে 'নোয়েল এন্ড নোয়েল' কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ২৫০-টাকা বেতনে সে ভারতে আসে চাকুরি করতে আসেন রুমানিয়ান মির্চা এলিয়াদ। উদ্দেশ্য চাকুরির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি আর জ্ঞান সাধনা। এবং ঘটনাক্রমে ড. সেনের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হয় তখনকার খৃস্টধর্মী ইউরোপিয়ান শেতাঙ্গ মির্চা। মৈত্রেয়ী দেবী যাকে আদর করে 'রু' নামে ডাকতেন বাবা মা তাকে তখনকার ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়ল মির্চার ওপর। আর মেয়েটিকে দেয়া হলো মির্চাকে ঐ সময়ের কলকাতার বাংলা শেখানোর কাজ। ১৯৩০-সালে ঐ যুগের আধুনিক ও অনন্য ষোড়শী অমৃতার রোমানিয়ার এ তরুণের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনা। তবে এ সম্পর্ক তারা গোপন রাখতেও পারেনি বেশিদিন। অল্পদিনেরই অভিভাবকেরা বিষয়টি জেনে যায়। জাতপাত তথা ধর্মীয় কারণে মির্চাকে শিক্ষকের বাড়ি থেকে চলে যেতে এবং আর কখনোই মৈত্রেয়ীর সাথে যোগাযোগ না করতে কঠোরতর নির্দেশ দেয়া হয়। 

ছবি: মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদ

কিন্তু সন্ন্যাসজীবন শেষে পরবর্তীতে সেই তরুণই এসব ঘটনাসমূহ নিয়ে লিখেন একটি আধা-আত্মজৈবনিক উপন্যাস 'লা নুই বেঙ্গলি' মানে 'বাংলার রাত' ইংরেজি নাম 'বেঙ্গল নাইটস'। আর এই এক বইয়েই তিনি পরিচিতি পান বিশ্বখ্যাত দার্শনিক হিসেবে। কিন্তু এই উপন্যাসের কথা চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পর জানতে পারেন মৈত্রেয়ী দেবী। ১৯৭২-সালের দিকে লেখকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোলকাতায় এলে অমৃতা জানতে পারেন যে, বইটিতে তাদের দুজনের 'যৌন' সম্পর্কের বর্ণনা করা হয়েছে। মূলত এই কথার প্রতিবাদ জানাতেই প্রায় ষাট বছর বয়সে মৈত্রেয়ী দেবী লিখেন সেই উপন্যাসের প্রতিউত্তর 'ন হন্যতে'। 

মৈত্রেয়ী দেবীকে পাঠক সমাজে এক অনন্য স্থান এনে দেয় ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তার এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। লেখিকার গভীর জীবনবোধ আর নিপুন দক্ষতায় ব্যক্তিগত প্রেমের কাহিনী, উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়ে, তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। তাই ‘ন হন্যতে’ বাংলা ভাষায় বহুল পঠিত স্মৃতিচারণমূলক এক অসামান্য উপন্যাস। ১৯৭৬ সালে এই বইটির জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, ‘ন হন্যতে’ একাডেমিক পুরস্কারপ্রাপ্ত একালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বইটি ইংরেজি ভাষায় ‘ইট ডাজ নট ডাই’ নামে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনুবাদ করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’  উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে বক্তৃতা দেয়ার জন্য তিনি সোভিয়েত রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও জার্মানিতে গিয়েছিলেন। তার ‘অচেনা চীন’, ‘মহাসোভিয়েত’, ‘চীনে ও জাপানে’ প্রভৃতি গ্রন্থ এ বিষয়ে স্মরণীয়। দেশ পত্রিকায় লিখা তার ধারাবাহিক ‘চীন দেখে এলাম’ ভ্রমনকাহিনী দেশে সাড়া ফেলেছিল। বিশেষ করে কমিউনিস্ট শাসিত চীনের জীবনযাপন দেশের মানুষকে তখন নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল।

ছবি: মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদ

সমাজসেবা
সাহিত্যরচনা ছাড়াও সমাজসেবামূলক কাজে নিবেদিত ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে তিনি ‘কাউন্সিল ফর প্রমোশন অব কমিউনাল হারমনি’ সংস্থা স্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সমর্থনে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শরনার্থী শিবিরের অনাথ শিশুদের জন্য তিনি ‘খেলাঘর’ স্থাপন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ সংস্থার কাজ কর্ম দেখাশুনা করেছেন।

মৃত্যু
১৯৯০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মৈত্রেয়ী দেবী।

তথ্যসূত্র
১। "মৈত্রেয়ী দেবী"। দৈনিক মানবকণ্ঠ। ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। সংগৃহীত ২১ অক্টোবর, ২০১৬।
২। History of the College
৩। দিনেশচন্দ্র জয়ধর (১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)। "অনন্য সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী"। এইবেলা। সংগৃহীত ২১ অক্টোবর, ২০১৬।
৪। চৌধুরী, রুসেলি রহমান (২০০৬)। বরিশালের প্রয়াত গুণীজন। ঢাকা, বাংলাদেশ: ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিশার্স।
৫। মীর ওয়ালীউজ্জামান (৭ মার্চ ২০১১)। "পঞ্চম কাহন: ক্রিসমাসে দার্জিলিং"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সংগৃহীত ২১ অক্টোবর, ২০১৬।
৬। "ন হন্যতে মৈত্রেয়ী দেবী (আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস)"। আমার বই। সংগৃহীত ২১ অক্টোবর, ২০১৬।
৭। Devi, Maitreyi (১৯৭৩)। Rabindranath--the man behind his poetry। Sudhir Das at Nabajatak Printers।
৮। গাজী সাইফুল ইসলাম (ডিসেম্বর ৪, ২০১৪)। "মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাস 'ন হন্যতে'"। যায়যায়দিন। সংগৃহীত ২১ অক্টোবর, ২০১৬।
৯। ইস্টিশন ব্লগ