বেনজীর ভুট্টো: এক লড়াকু রাজনীতিবীদ

প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:১১ | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:৫১

মাথায় পাতলা এক রঙা ওড়না, পরনে সালোয়ার কামিজ, মুসলিম প্রধান একটি দেশের রাজনীতির মাঠে ছাদ খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন-এ দৃশ্যের সাথে যার মুখটি ভেসে উঠে তিনি হলেন বেনজীর ভুট্টো। পাকিস্তানের মত একটি কট্টরপন্থী দেশের শীর্ষপদে দু’বার আরোহন করে মুসলিম বিশ্বে তাক লাগিয়ে দেয়া প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো। 

শৈশব ও প্রথম জীবন
বেনজীর ভুট্টো ১৯৫৩ সালের ২১ জুন পাকিস্তানের করাচীতে এক ধনাঢ্য এবং রাজনৈতিক সচেতন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং মাতা ছিলেন বেগম নুসরাত ইস্পাহানি। চার ভাইবোনের মধ্যে বেনজীরই ছিলেন সবার বড়।

শিক্ষাজীবন
বেনজীরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় লেডি জেনিংস নার্সারি স্কুল দিয়ে। পরে তাকে পাক-ভারত সীমান্তে অবস্থিত ম্যুরের একটি বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে ‘ও’ লেভেল পাস করেন এবং করাচী গ্রামার স্কুল থেকে পরে ‘এ’ লেভেল পাস করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির রেডক্লিফ কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে থাকাকালীন সময়ে বেনজীর সর্বপ্রথম পাশ্বাত্য জগতের মুক্ত পরিবেশ ও চিন্তাধারা, জীবনপ্রণালীর সাথে পরিচিত হন।

বেনজীর হার্ভার্ডে থাকাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের শেষে PPP-এর (Pakistan People Party) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রথম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।

এরপর বেনজীর ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য আসেন। অক্সফোর্ডে আসার পর তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হলেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং কূটনীতি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করলেন। অক্সফোর্ডে থাকাকালীন তিনি বিতর্ক সভায় যোগদান করেন এবং প্রথমবারের মতো একজন অ-ইংরেজ হিসেবে এই ক্লাবের প্রেসিডেন্টের পদ অলঙ্কৃত করেন।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৭৭ সালে বেনজীর ভুট্টো অক্সফোর্ডে পড়াশুনা শেষ করে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করে সেনা শাসক জিয়াউল হক। সামরিক অভ্যুত্থানের পর জুলফিকার আলীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জুলফিকার আলী কারাগারে থাকাকালীন তার স্ত্রী নুসরাত আলী ভুট্টো এবং কন্যা বেনজির ভুট্টো পিপলস্ পার্টির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। জিয়াউল হক ১৯৭৯ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসির আদেশ দেয়। পিতার মৃত্যুর পর বেনজীর সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কাজ করা শুরু করেন। এসময় সেনা শাসক জিয়াউল হক সরকার মোট ৮ বার বেনজীরকে গৃহবন্দী ও কারাবন্দী করে। ১৯৭৮ সালে তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯৮৪ সালে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে লন্ডন চলে যান। লন্ডনে নির্বাসনে যাওয়ার আগে ৩ বছর তিনি গৃহবন্দী ছিলেন। লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে রহস্যজনকভাবে তার ভাই শাহনাওয়াজ ভুট্টোর মৃত্যু ঘটে, যিনি এসময় প্যারিসে অবস্থান করেছিলেন। শাহনাওয়াজ ভুট্টোকে বিষপানে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৮৫ সালে বেনজীর মৃত ভাই শাহনাওয়াজের লাশ নিয়ে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এখানে আসার পর তিনি জিয়াউল হকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দেন এবং পাকিস্তান সরকারকে তাঁর ভাই-এর হত্যার জন্য দায়ী করেন। এসময় বেনজীরকে আবারো গ্রেপ্তার করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডনে ফিরে যান। ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং বেনজীরকে পাকিস্তানে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তণের অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি যখন ফিরে আসেন তখন তাঁর পার্টির হাজার হাজার সমর্থক তাকে সংবর্ধনা দেয়।

১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান পিপলস্ পার্টিকে ঢেলে সাজান বেনজীর ভুট্টো এবং তার মাতা নুসরাত ভুট্টো এবং যৌথভাবে তারা পার্টির কো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে বেনজীর সিন্ধু প্রদেশের ব্যবসায়ী আসিফ জারদারীকে বিয়ে করেন। এ দম্পতি ৩ সন্তানের জনক-জননী হন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেনজীর
এদিকে বিয়ের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক আন্দোলনে অধিক মনোনিবেশ করেন বেনজীর। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয় বেনজীর সমর্থিত পাকিস্তান পিপলস পার্টি। মাত্র ৩৫ বছরে প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করে ইতিহাস গড়েন বেনজীর ভুট্টো। ক্ষমতায় বসার পর তিনি দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেন। তিনি গণতন্ত্রকে সুদূরপ্রসারী করার চেষ্টা করেন, সমাজসেবামূলক অনেক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। তিনি নারীদের সুযোগ সুবিধা দানের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেন। তিনি নারীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচারক, পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন। তিনিই প্রথম রক্ষণশীল পাকিস্তান সমাজে নারীদের দ্বারা পরিচালিত নারী পুলিশ বাহিনী গঠন করেন। ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই বছরের মাথায় আমেরিকার প্ররোচনায় বেনজীর ভুট্টোকে পদ থেকে অব্যাহতি দেন পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গুলাম ইসহাক খান।

১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে আবারো বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং বেনজীর ভুট্টো দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন। এসময় তিনি দেশের আনাচে কানাচে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা জোরদারের জন্য কাজ করে যান। এসময় তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবন সঙ্কটাময় হয়ে পড়ে বেনজীরের। রাজনৈতিক বিরোধী দলের ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা করা ছাড়াও, তার ছোট ভাই মুর্তাজা ভুট্টো দশ বছর নির্বাসনে থাকার পর পাকিস্তানে এসে পিপলস্ পার্টির নেতৃত্ব দাবি করেন এবং এই দাবিতে ইন্ধন জোগান তার মাতা নুসরাত ভুট্টো। এর মধ্যে আততায়ীর হাতে মুর্তাজা ভুট্টোর হত্যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল হয়ে পড়ে। বিরোধী দল অভিযোগ করে যে, বেনজীর এবং তার স্বামী জারদারী এই হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। এভাবে পরিস্থিতি যখন জটিল আকারে ধারণ করলে বেনজীরকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ওয়াসিম সাজ্জাদ। এ সময় তিনি ও তার স্বামী জারদারীকে গ্রেপ্তার করে কারাদন্ড দেয়া হয়। ফলে আবারো তিনি নির্বাসনে লন্ডনে পাড়ি জমান।

মৃত্যু
২০০৭ সালে পাকিস্তানের তদান্তীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ আর বেনজীর ভুট্টোর মধ্যে রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে এক দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে প্রায় ৮ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে ২০০৭ সালের অক্টোবরে করাচীতে ফিরেন বেনজীর ভুট্টো। দেশে ফেরার দিনই করাচীর বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ১৪০ জন নিহত এবং ৫০০ জনের মত আহত হয়। সেবার অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও মৃত্যু বেনজীরের পিছু ছাড়েনি। ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে এক নির্বাচনী সভায় আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন এই লড়াকু রাজনীতিবিদ। এ সময় বোমা হামলায় ২০ জন নিহত এবং প্রায় ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়। নিহত বেনজীরের লাশ তার নিজ শহর ঘারি খোদা বকসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।