কোরাজন এক্যুইনো: ফিলিপাইনের গণতন্ত্রের এক অনন্য যোদ্ধা
প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:৪০ | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:০৬
কোরাজন এক্যুইনো ছিলেন ফিলিপাইন এবং এশিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। তিনি ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রব্যবস্থার ১১তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। ঐ বছরই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইমস ম্যাগাজিন কোরাজনকে “পারসন অব দ্য ইয়ার” হিসেবে সম্মানিত করে।
শৈশব ও প্রথম জীবন
কোরাজনের পূর্ণ নাম মারিয়া কোরাজোন সুমুলুং কোযুয়াংগো। তিনি ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ সালে ফিলিপাইনসের ধনাঢ্য এবং রাজনৈতিক সচেতন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামহ সিনেটার হিসেবে অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। তার পিতার নাম হোসে কোযুয়াংগো (Jose Cojuangu), পেশায় একজন কংগ্রেসম্যান এবং মাতা ছিলেন ডেমিট্রিয়া, পেশায় একজন ফার্মাসিস্ট। ফিলিপাইনসের তারলাক প্রদেশে হোসে কোযুয়াংগো মূলত আখের মিল এবং কৃষিকাজ করতেন। ৮ ভাইবোনের মধ্যে কোরাজন ছিলেন ষষ্ঠ।
শিক্ষাজীবন
কোরাজন তার পড়াশুনা শুরু করেন ম্যানিলার সেন্ট স্কলাস্টিকা কলেজ থেকে। সেখানে উচ্চতর শিক্ষায় তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া এবং নিউইয়র্কে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। নিউইয়র্কের কলেজ অব মাউন্ট ভিনসেন্ট থেকে অংক শাস্ত্র এবং ফরাসি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে তিনি রিপাবলিকান প্রার্থী থমাস ডেয়ের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি দেশে ফিরে আইনজীবি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার পরিকল্পনা করেন এবং ১৯৫৩ সালে ফার ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন।
পারিবারিক জীবন
এসময় কোরাজনের সাথে ফিলিপাইনের সিনেটের প্রয়াত স্পিকার বেনিগনো এক্যুইনোর ছেলে তরুণ রাজনীতিবিদ নিনয় এক্যুইনোর সাথে পরিচয় হন। ১৯৫৬ সালে তিনি নিনয়কে বিবাহ করেন এবং আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন থেকে বিরত থাকেন। এসময় ৫ সন্তানের মাতা-পিতা হন এই কোরাজন-নিনয় দম্পতি।
কোরাজনের সাথে বিবাহের পর নিনয়ের রাজনৈতিক জীবন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। তৎকালীন লিবারেল পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে নিনয় সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ফিলিপাইনের সবচেয়ে তরুণ সিনেটর।
রাজনৈতিক জীবন
কোরাজন এক্যুইনো যখন বিবাহ করেন তখন ফিলিপাইনসে ফার্ডিনান্দ মার্কস একনায়কতন্ত্র শাসন জারি করেন এবং তার স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করেন বিরোধী দলের প্রভাবশালী সদস্য নিনোয় এক্যুইনো। ১৯৭২ সালে নিনোয়কে প্রেসিডেন্ট মার্কস গ্রেপ্তার করে হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সাত বছর কারাদন্ডে দন্ডিত করেন।
কারাবরণকালে কোরাজন এক্যুইনো বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৮ সালে তিনি সর্বপ্রথম স্বামীর পক্ষে রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন। ১৯৮০ সালে নিনোয়কে হৃৎপিন্ডে অস্ত্রপোচারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি তার স্ত্রী কোরাজনসহ বোস্টনে তিন বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। ১৮৮৩ সালে নিনোয় ম্যানিলা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করার পর মার্কাসের গোয়েন্দা বাহিনী তাকে হত্যা করে। ফিলিপাইনসে তখন সামরিক শাসন বলবৎ ছিল।
স্বামী নিনয়ের মৃত্যুর পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন কোরাজন। তার বক্তৃতার কারণে মার্কাসের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঝড় উঠে সমগ্র ফিলিপাইনসে। কোরাজন এক্যুইনো ফিলিপাইনসের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসমাবেশ করে তার স্বামীর হত্যার বিচারের দাবি জানান। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাবেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল হয়।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী লড়াইয়ের জন্য প্রথমে রাজি ছিলেন না কোরাজন। কোরজনকে রাজি করানোর জন্য ফিলিপাইনসের জনগণ প্রায় ১ মিলিয়ন গণস্বাক্ষর দেয়। জনগণের দাবীর মুখে কোরাজন এক্যুইনো প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। স্বেচ্ছাচারী মার্কাস এসময় কোরাজনকে “নারী” হিসেবে উল্লেখ করে দেশ চালানোর ক্ষেত্রে তার অনভিজ্ঞতা এবং কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জবাবে কোরাজন বলেছিলেন, “জনগণের সাথে প্রতারণা করা, তাদের টাকা চুরি করা, মিথ্যা আশ্বাস দেয়া এবং বিরোধীদলের নেতাদেরকে হত্যা করার অভিজ্ঞতা আমার নেই”।
পরবর্তীতে নির্বাচন স্বেচ্ছাচারী শাসক মার্কস বানচাল করে দেয়। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এনরিল এবং সামরিক বাহিনীর ডেপুটি চিফ ফিডেল রেমস এক্যুইনো কোরাজনকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন।
এসময় সমগ্র দেশে গণঅভ্যুত্থান দেখা দেয় এবং জনগণ বিদ্রোহী সৈন্যদের সমর্থন দেয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এরূপ ভয়াবহ আকার ধারন করে যে মার্কস তার স্ত্রী এমেরেলডাকে নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে জীবনরক্ষা করেন। ক্ষমতালাভ করেন ফিলিপাইনসের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট কোরাজন এক্যুইনো।
শুরুতে কোরাজন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। সমগ্র দেশে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ চলছিল; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা, দুর্নীতিমূলক শাসন কাঠামো, মার্কসের সমর্থকদের হামলা প্রভৃতি। প্রেসিডেন্ট এক্যুইনো ধীরে ধীরে সমস্ত সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন। তিনি রোমান ক্যাথলিক গীর্জার সমর্থন লাভ করেন। একটি রেফারেন্ডামের মাধ্যমে তিনি সংবিধানের সমর্থন পান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ও সমর্থনে শাসনকার্য পরিচালিত করতে থাকেন। ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে তিনি সতেরো বছর ব্যাপী কমিউনিস্টদের গেরিলা যুদ্ধের সমাপ্তি করতে সমর্থন হন। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র অব্যহত ছিল। যার ফলে তিনি ১৯৮৬ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এনরিলকে পদচ্যুত করেন।
১৯৮৭ সালে পুনরায় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে তিনি তার রাজনৈতিক পদমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু সেনাবাহিনীতে বিক্ষোভ দেখা দিলে তিনি কঠোর হস্তে তা দমন করে। ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্টের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং তার স্থলে ফিডেল রেমসকে সমর্থন দেন। রেমস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
অবসরের পর কোরাজন আবার তার সাদামাটা পারিবারীক জীবনে ফিরে যান। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ। তবে রাজনীতি থেকে অবসরের পরেও কোরাজন নিয়মিত দেশের রাজনীতিতে সরব ছিলেন। সরকার আর বিরোধীদলের নানা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তিনি এসময় নানা দেশ ভ্রমন করেন এবং গণতন্ত্র, মানবতা, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে বক্তৃতা দেন। জীবিত অবস্থায় তিনি নানা সম্মান এবং পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক রৌপ্যপদক, ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে পাথ অব পিস এওয়ার্ড, ১৯৯৮ সালে রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।
২০০৮ সালে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন কোরাজন এবং ২০০৯ সালের ১ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন এই রাজনীতিবিদ।