দুইবার নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মারি ক্যুরি
প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০১৭, ১৬:০৮ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৯, ১৩:৫৫
মারি ক্যুরি (Marie Curie) প্রথম নারী বিজ্ঞানী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই ফরাসি বিজ্ঞানী ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য তার স্বামী পিয়ের ক্যুরি এবং তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক অঁরি বেকেরেলের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। সেই ছিলো প্রথম নারী বিজ্ঞানী যে বিজ্ঞানের দুইটি ভিন্ন শাখায় দুইবার নোবেল পুরস্কার জেতেন। সে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম নারী অধ্যাপক ছিলেন এবং সেই ছিল প্রথম নারী যার অসামান্য মেধার কারণে ১৯৯৫ সালে প্যান্থিয়নে সমাহিত করা হয়।
মারি ক্যুরি ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ার্সাতে জন্মগ্রহণ করেন, যেটি তখন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো। মারি কুরি ওয়ার্সার গোপন ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং ওয়ার্সাতেই তার ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। ১৮৯১ সালে ২৪ বছর বয়সে সে তার বড় বোন ব্রোনিস্লাভাকে অনুসরণ করে প্যারিসে পড়তে যান। সেখানেই সে তার পরবর্তী বৈজ্ঞানিক কাজ পরিচালিত করেছিলেন। ১৯০৩ সালে মারি কুরি তার স্বামী পিয়েরে কুরি এবং পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেলের সাথে পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জেতেন। তিনি এককভাবে ১৯১১ সালে রসায়নেও নোবেল পুরস্কার জেতেন।
পদার্থবিজ্ঞানে তিনি নোবেল পান তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করার জন্য। আর রসায়নে নোবেল পান পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথক করার জন্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাসপাতালগুলোতে এক্স-রের সরঞ্জামের ঘাটতি ছিল। যুদ্ধাহত রোগিদের এক্সরে সঠিকভাবে করানোর অর্থ যোগাতে তিনি তহবিল সংগ্রহে নামেন। এসময় অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ২২০ টি রেডিওলোজি স্টেশন গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ২০০ টি ছিল বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী ছিল, এবং ২০ টি ছিল ভ্রাম্যমান। এগুলো তিনি বিভিন্ন ধনী মহিলাদের কাছ থেকে গাড়ি ধার নিয়ে তৈরী করেছিলেন। তিনি নিজেও বিভিন্ন স্টেশনে এক্সেরে করতে সাহায্য করতেন এবং যুদ্ধের সময় তার গড়া এই রঞ্জনবিদ্যা ইনস্টিটিউটগুলোয় প্রায় ১০ লাখ যুদ্ধাহতের এক্স রে করা হয়েছিল।
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসতে নিজের গড়া রেডিয়াম ইনস্টিটিউটসহ তিনি অন্য একটি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে কাজ করতেন। রেডিয়াম বিষয় নিয়ে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গবেষণা করে তিনি তার মেয়ে ইরিন, মেয়ের স্বামী ফ্রেডরিক জুলিয়েটের সাথে যৌথভাবে নোবেল পান।
ফ্রান্সের একজন নাগরিক হিসেবে থাকা অবস্থায়ও মারি স্ক্লদভস্কা ক্যুরি (তিনি তাঁর দুটো উপাধিই লিখতেন) তাঁর পোলিশ পরিচয় ভুলে যাননি। তিনি তাঁর কন্যাদের পোলিশ ভাষা শিখিয়েছিলেন এবং তাদের পোল্যান্ডে নিয়েও গিয়েছিলেন। তিনি নিজে প্রথম যে মৌলটি আবিষ্কার করেন, তাঁর জন্মভূমির নামানুসারে ঐ মৌলের নাম দেন পোলনিয়াম। গবেষণার সময় নিজের জামার পকেটে রেডিয়াম পূর্ণ টেস্টটিউব রাখা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজের তৈরি ভ্রাম্যমাণ এক্স রশ্মি ইউনিটে কাজ করার মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তার সম্পর্কে আসায় অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানেমিয়া হওয়ায় মারি ক্যুরি ১৯৩৪ সালে ফ্রান্সের (হাউতে-সাভইয়ের) সাঞ্চেল্লেমজের একটি স্বাস্থ্যনিবাসে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রাথমিক জীবন
রাশিয়া বিভাগের সময় পোল্যান্ডের ওয়ার্সতে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর মারি ক্যুরি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত শিক্ষক বরিন্সলা, নী বগুস্কা ও ভ্লাদিস্লাও স্ক্লদভস্কির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্ব-কনিষ্ঠ। ক্যুরির জ্যেষ্ঠ ভাই বোনদের নাম জোফিয়া (জন্ম ১৮৬২), জোজেফ (জন্ম ১৮৬৩), বরিন্সলা (জন্ম ১৮৬৫) এবং হেলেনা (জন্ম ১৮৬৬)।
যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮৭৮ সালে ক্যুরির মা মারা যান। তাঁর তিন বছর আগে ক্যুরির জ্যেষ্ঠ বোন জোফিয়া এক বাসিন্দার কাছ থেকে জ্বরবিকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারিয়ার বাবা ছিলেন একজন নাস্তিক আর তাঁর মা ছিলেন একজন নিবেদিত ক্যাথলিক। মা ও বোনের মৃত্যু মারি ক্যুরিকে ক্যাথলিক থেকে অজ্ঞেয়বাদীতে পরিণত করে। ১০ বছর বয়সে মারিয়া ভর্তি হয়েছিলেন যে.সিকরস্কা পরিচালিত বোর্ডিং স্কুলে। পরে তিনি বালিকাদের জিমনেশিয়ামে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৮৮৩ সালের ১২ জুন স্বর্ণপদক সহ স্নাতক লাভ করেন। পরের বছর তিনি তাঁর পিতার নিকটাত্মীয়ের সাথে গ্রামে এবং তারও পরবর্তী বছর তাঁর পিতার সাথে ওয়ার্সতে বসবাস করেন এবং কিছু সময় গৃহ শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
মেয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে মারি ক্যুরি কোন নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেননি। তাই তিনি এবং তাঁর বোন বরিন্সলাও ক্ল্যান্ডেসটাইন ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন, এটি উচ্চশিক্ষা প্রদানে নিবেদিত একটি পোলিশ দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান ছিল যা মেয়ে শিক্ষার্থীকেও ভর্তি করত।
নতুন মৌল
১৮৯৫ সালে উইলহেলম রন্টগেন্ট এক্স-রে আবিষ্কার করেন। তবে এগুলো কি কারণে তৈরি হয় তা তখনো অজানা ছিল। ১৮৯৬ সালে হেনরি বেকেরেল আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম লবণ একধরণের রশ্মি নিঃসরণ করে যাদের কোন কিছু ভেদ করার ক্ষমতা এক্স-রশ্মির সমতুল্য। তিনি দেখান যে এই রশ্মিগুলো ফস্ফোরেসেন্সের মত নয়, বাইরের কোন শক্তির সাহায্য ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এরা নির্গত হয়। এই দুইটি আবিষ্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মারি ক্যুরি ইউরেনিয়াম রশ্মির উপর গবেষণা শুরু করেন। তিনি নমুনা পরীক্ষার জন্য একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ঘটনার ১৫ বছর আগে তাঁর স্বামী ও দেবর একটি উন্নত ইলেকট্রোমিটার তৈরি করেন যা বৈদ্যুতিক চার্জ পরিমাপ করতে পারত। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে মারি আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম রশ্মি একটি নমুনার আশেপাশের বাতাসে তড়ি চালনা করে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি প্রথম যে বিষয় বুঝতে পারেন তা হচ্ছেঃ ইউরেনিয়াম যৌগ সমূহের কার্যকলাপ শুধুমাত্র এতে উপস্থিত ইউরেনিয়ামের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। তিনি হাইপোথিসিস দেন যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ একাধিক কণার সংঘর্ষের কারণ নয় বরং একটি পরমাণু নিজেই এর কারণ। প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী অণু অদৃশ্য; এই ধারণা ভুল প্রমাণে তাঁর হাইপোথিসিস গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৮৯৭ সালে তাঁর মেয়ে আইরিন জন্ম নেয়। আয় বাড়ানোর জন্য ক্যুরি একোল নরমাল সুপেরিয়রে শিক্ষকতা শুরু করেন। ক্যুরিদের কোন নিজস্ব গবেষণাগার ছিল না; তাঁদের বেশিরভাগ গবেষণা সম্পন্ন করেছিলেন স্কুল অফ ফিজিক্স অ্যান্ড কেমিস্ট্রির এক জায়গায়। সেটি মেডিক্যাল স্কুলের ব্যবচ্ছেদ রুম ছিল, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ছিল না এবং পানিরোধক ও ছিল না। তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে থাকার ক্ষতিকর পরিণাম সম্পর্কে তখন অজ্ঞাত থাকায় তাঁরা কোন নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি। স্কুল গবেষণার জন্য তাঁকে কোন অর্থ সহায়তা না দিলেও তিনি বিভিন্ন ধাতব সংক্রান্ত ও খনন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার সাহায্য পেয়েছিলেন। ক্যুরিদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল দুইটি ইউরেনিয়াম খনিজ, পিচব্লেন্ডে এবং টরবারনাইট (যা চ্যালকোলাইট নামেও পরিচিত ছিল) তাঁর ইলেকট্রোমিটার দেখায় যে পিচব্লেন্ডে ইউরেনিয়ামের চারগুন এবং চ্যালকোলাইট দ্বিগুণ সক্রিয় ছিল। তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ইউরেনিয়ামের পরিমাণের ভিত্তিতে সক্রিয়তা পরিমাপ সংক্রান্ত তাঁর প্রথম ধারণা সঠিক হলে ঐ দুইটি খনিজ অল্প পরিমাণে এমন একটি বস্তু ধারণ করে যার সক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি তিনি তখন আরও কতগুলো মৌলের সন্ধান শুরু করেন যারা তেজস্ক্রিয়তা দেয় এবং ১৮৯৮ সালে আবিষ্কার করেন যে থোরিয়ামে এই ধর্ম আছে। পিয়েরে, মারির কাজে এতই আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে ১৮৯৮ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি কেলাসের উপর গবেষণা ছেড়ে মারির গবেষণায় সাহায্য শুরু করেন।
মারি খুব দ্রুত তাঁর গবেষণা প্রকাশ করে তাঁর গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যদি না বেকেরেল, তাঁর আবিষ্কারকে উদ্ভাবনের পরের দিনই প্রকাশ না করে দুই বছর পর প্রকাশ করতেন অ্যাকাডেমি ডেস সাইন্সেস-এ তবে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের কৃতিত্ব ও একটি নোবেল পুরস্কার চলে যেত সিলভেনাস থমসনের কাছে। ক্যুরিও একই দ্রুততায় আবিষ্কার প্রকাশ করেন। তাঁর গবেষণা পত্রে তাঁর কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে ১৮৯৮ সালের ১২ এপ্রিল তাঁর সাবেক অধ্যাপক গ্যাবরিয়েল লিপম্যানের সাহায্যে ‘অ্যাকাডেমিতে’ প্রকাশ করেন। তারপরও, থমসন যেমন বেকেরেলের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, তেমনি প্রতিযোগিতার দৌড়ে ক্যুরিও উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলেন যে থোরিয়ামও তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমন করে। দুই মাস আগে গারহার্ড কার্ল স্মিথ,বার্লিনে নিজের গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন সেই সময়ে পদার্থবিজ্ঞান জগতের কেউই খেয়াল করেননি যে ক্যুরি পিচব্লেন্ড এবং চ্যালকোলাইটের সক্রিয়তা যে ইউরেনিয়াম থেকে কত বেশি তা উল্লেখ করেছেন: “বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে এই খনিজগুলো সম্ভবত এমন একটি মৌল ধারণ করে যা ইউরেনিয়াম থেকে বেশি সক্রিয়” মারি পরবর্তীতে তাঁর অনুভূতি সম্পর্কে মনে মনে ভাবতেন “এই হাইপোথিসিসকে যত দ্রুত সম্ভব যাচাই করার একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষা (a passionate desire to verify this hypothesis as rapidly as possible.)” ১৮৯৮ সালের ১৪ এপ্রিল ক্যুরিরা খুব আশাব্যঞ্জক ভাবে পিচব্লেন্ডের ১০০ গ্রামের একটি নমুনা পেয়েছিলেন এবং পেসল ও মর্টার দিয়ে একে চূর্ণ করেছিলেন। সেই সময়ে তাঁরা ধারনাও করতে পারেননি তাঁরা যা খুঁজছেন তা এত অল্প পরিমাণে রয়েছে যে তাঁদের পরবর্তীকালে এটার জন্য টনের পর টন খনিজ বিশ্লেষণ করতে হবে। ১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে ক্যুরি এবং তাঁর স্বামী যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে একটি মৌলের অস্তিত্ব ঘোষণা করেন যার নাম দেয়া হয় “পোলনিয়াম”, ক্যুরির জন্মস্থান পোল্যান্ডের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই নাম দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে আরও বিশ বছর তিনটি সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল ঐ বছরেরই ২৬ ডিসেম্বরে ক্যুরিরা দ্বিতীয় একটি মৌলের অস্তিত্ব ঘোষণা করেন, তাঁরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘রেডিয়াম’, এই শব্দের উপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘রে’ থেকে। তাঁদের গবেষণা চালাতে চালাতেই তাঁরা ‘তেজস্ক্রিয়তা’ শব্দটি প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁদের আবিষ্কারকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠানোর জন্য তাঁরা পোলনিয়াম এবং রেডিয়াম বিশুদ্ধ আকারে পাওয়ার চেষ্টা করেন। পিচব্লেন্ড হচ্ছে একটি জটিল খনিজ; এর গঠন উপাদানগুলো রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন। পোলনিয়ামের আবিষ্কার এর চেয়ে সহজ ছিল; রাসায়নিক দিক থেকে এটি বিসমাথের মত, এবং এটিই ছিল একমাত্র বিসমাথ সদৃশ ধাতু যা খনিতে পাওয়া যায়। রেডিয়াম পাওয়া একটু বেশি কঠিন, রাসায়নিকভাবে এর সাথে বেরিয়ামের মিল রয়েছে এবং পিচব্লেন্ডে দুইটি উপাদানই রয়েছে। ১৮৯৮ সালের মধ্যে ক্যুরিরা রেডিয়ামের অস্তিত্ব পেয়েছিলেন, তবে বেরিয়াম মুক্ত অর্থা বিশুদ্ধ ও ব্যাপক পরিমাণে রেডিয়াম পেতে তখনো অনেক দেরি ছিল। ক্যুরিরা রেডিয়াম লবণ বিশ্লেষণ করার মত দুঃসাধ্য কাজ শুরু করেন ব্যবকলনীয় কেলাসন প্রক্রিয়ায়। ১৯০২ সালে ১ টন পিচব্লেন্ড থেকে ১ গ্রামের ১০ ভাগের ১ ভাগ রেডিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া গিয়েছিল। ১৯১০ সালে মারি ক্যুরি বিশুদ্ধ রেডিয়াম ধাতু লাভে সক্ষম হন। তিনি কখনো বিশুদ্ধ পোলনিয়াম পাননি, যার অর্ধায়ু মাত্র ১৩৮ দিন অর্থা বিশুদ্ধ পোলনিয়াম পাওয়ার ১৩৮ দিন পর এর ভর মোট ভরের অর্ধেক হয়ে যায় এবং এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে। ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯০২ সালের মধ্যে ক্যুরিদ্বয় (পিয়েরে এবং মারি) একসাথে কিংবা এককভাবে ৩২টি বৈজ্ঞানিক পত্র প্রকাশ করেন যাদের একটি উল্লেখ ছিল যে রেডিয়ামের প্রভাবে রোগাক্রান্ত, টিউমার সৃষ্টিকারী কোষ সুস্থ কোষের চেয়ে তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয়। ১৯০০ সালে ক্যুরি একোল নরমাল সুপেরিয়র এর প্রথম ফ্যাকাল্টি সদস্য হন এবং তাঁর স্বামী প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিতে যোগ দেন। ১৯০২ সালে বাবা মারা যাওয়ার কারণে মারি পোল্যান্ড যান।
১৯০৩ সালে গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের তত্ত্বাবধানে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ঐ মাসেই ক্যুরি দম্পতি লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউটে তেজস্ক্রিয়তার উপর ভাষণ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান। নারী হওয়ার কারণে মারি ভাষণ দেয়ার অনুমতি পাননি। শুধু পিয়েরে বক্তব্য রাখেন। ক্যুরি দম্পতি তাঁদের আবিষ্কারের পেটেন্ট করে রাখেননি এবং এর ব্যবসায় বেড়ে চলা আয়ের খুব সামান্যই তাঁরা পেয়েছিলেন।
নোবেল পুরষ্কার
১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স হেনরি বেকেরেল কর্তৃক উদ্ভাবিত বিকিরণের উপর সমন্বিত গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ পিয়েরে ক্যুরি, মারি ক্যুরি এবং হেনরি বেকেরেলকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করে। প্রথমে কমিটি শুধুমাত্র পিয়েরে এবং বেকেরেলকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু কমিটির একজন সদস্য এবং নারী বিজ্ঞানীদের সমর্থক সুইডিশ গণিতবিদ ম্যাগ্নাস গোয়েস্তা মিত্তাগ-লেফফ্লের, পিয়েরেকে এই বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন এবং পিয়েরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মনোনয়নে মারির নাম যুক্ত করা হয়। মারি ক্যুরি ছিলেন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম নারী। ক্যুরি এবং তাঁর স্বামী পুরষ্কার গ্রহণের জন্য স্টকহোম যেতে অস্বীকার করেন; তাঁরা গবেষণায় অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলেন সেই সময় এবং পিয়েরে, যিনি আবার লোক সমাগম পছন্দ করতেন না, সেই সময় অসুস্থ ছিলেন এবং অসুস্থতা বেড়েই চলেছিল। যেহেতু নোবেল বিজয়ীদের একটি বক্তৃতা দিতেই হয়, তাই অবশেষে ১৯০৫ সালে তাঁরা পুরষ্কার গ্রহণের জন্য যাত্রা করেন। পুরষ্কার হিসেবে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ক্যুরি দম্পতি নিজেদের প্রথম গবেষণাগার সহকারী রাখতে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী অধ্যাপক। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন ল্যাবরেটরির সন্ধান তখনো জারি ছিল। পরবর্তী বছর গুলোতে ক্যুরি রেডিয়াম ইন্সটিটিউট পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। (ইন্সটিটুট দে রেডিয়াম, এখন ক্যুরি ইন্সটিটিউট, ইন্সটিটুট ক্যুরি), একটি তেজস্ক্রিয়তা সংক্রান্ত গবেষণাগার যা তাঁর জন্য তৈরি করেছিল পাস্তুর ইন্সটিটিউট এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়। পাস্তুর ইন্সটিটিউটের পরিচালক পিয়েরে পল এমিল রক্স খুবই হতাশ ছিলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর, যেহেতু তাঁরা যথার্থ গবেষণাগারের ব্যবস্থা করেনি এবং তিনি ক্যুরিকে প্রস্তাব দেন যেন তিনি পাস্তুর ইন্সটিটিউটে চলে আসে। ১৯০৯ সালে তাঁর উদ্যোগেই রেডিয়াম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব ঘটনার পর এবং ক্যুরি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার হুমকি দেয়ার পরই প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় নমনীয় হয়।
১৯১০ সালে ক্যুরি বিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথক করতে সক্ষম হন; তিনি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পরিমাপের একটি আন্তর্জাতিক এককও প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম পরবর্তীতে মারি ও পিয়েরেকে সম্মান দেখিয়ে “curie” রাখা হয়। তবে, ১৯১১ সালে ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স এক অথবা দুই ভোটের জন্য তাঁকে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেননি। তাঁর পরিবর্তে নির্বাচিত হন এডওয়ার্ড ব্র্যানলি, একজন আবিস্কারক যিনি গুগ্লিয়েমো মার্কোনীকে বেতার টেলিগ্রাফের উন্নয়নে সাহায্য করেন। এই ঘটনার অনেক বছর পরে মারির অধীনে ডক্টরেটকারী ছাত্রী মারগুরাইট পেরেই ঐ অ্যাকাডেমির একজন সদস্য নির্বাচিত হন। ফ্রান্সের একজন নারী বৈজ্ঞানিক হিসেবে সুনাম অর্জনের পরও ফ্রান্সের জনগণ তাঁকে ভিনদেশী ষড়যন্ত্রকারী মনে করত- একই ধরনের ধারণা পোষণের কারণে ড্রেইফাস কাণ্ড ঘটেছিল- এবং এই ধারণার কারণেই মিথ্যা অনুমান করা হয়েছিল যে ক্যুরি একজন ইহুদী। ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সের নির্বাচনের সময় ডানপন্থী গণমাধ্যম তাঁকে বিদেশী এবং নাস্তিক বলে কটাক্ষ করেছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁর মেয়ে জনগণের দুমুখো নীতির সমালোচনা করেছিলেন কারণ যখন মারি কোন ফরাসি সম্মাননার জন্য মনোনীত হতেন তখন গণমাধ্যম তাঁকে অযোগ্য বিদেশী হিসেবে উপস্থাপন করত আর যখন কোন আন্তর্জাতিক সম্মাননা যেমন নোবেল পুরস্কার পেতেন তখন তাঁকে ফ্রান্সের গর্ব হিসেবে উপস্থাপন করত। ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় যে ১৯১০-১১ সালে একবছর সময় ধরে মারি ক্যুরির সাথে পদার্থবিদ পল ল্যাঙ্গেভিনের সম্পর্ক ছিল। এটি ব্যপকভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং তাঁর বিরোধীরা এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। এই ঘটনা যখন জানাজানি হয়ে যায় তখন ক্যুরি বেলজিয়ামে একটি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। দেশে ফেরার পর তিনি তাঁর বাসার সামনে ব্যপক সংখ্যক উত্তেজিত জনতার ভিড় দেখতে পান এবং তাঁর মেয়ের বাসায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি একটি নতুন উচ্চতায় চলে গিয়েছিল এবং যাবতীয় বিরোধিতা প্রত্যাখ্যান করে ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার মাধ্যমে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স তাঁকে দ্বিতীয়বারের মত সম্মানিত করে। “রেডিয়াম ও পোলনিয়াম আবিষ্কার, রেডিয়াম পৃথকীকরণ এবং এইরকম অসাধারণ উপাদানের প্রকৃতি ও এদের যৌগের উপর গবেষণার মাধ্যমে রসায়নশাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটানোর স্বীকৃতিস্বরূপ” তাঁকে এই সম্মাননা দেয়া হয়। তিনি দুইটি নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী প্রথম নারী এবং শুধুমাত্র তিনি ও লিনাস পলিং একাধিক ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ঔপন্যাসিক হেনরিক সিএঙ্কিভিজের নেতৃত্বে একটি পোলিশ প্রতিনিধি দল তাঁকে পোল্যান্ডে ফিরে এসে নিজ দেশে গবেষণা কার্যক্রম চালাতে অনুরোধ করে। ক্যুরির দ্বিতীয়ও নোবেল পুরস্কার অর্জন তাঁকে ফরাসি সরকারকে রেডিয়াম ইন্সটিটিউট তৈরিতে সহযোগিতা করতে রাজি করাতে সক্ষম করে তোলে; যেখানে রসায়ন, পদার্থ ও মেডিসিনের উপর গবেষণা হত। ১৯১১ সালে নোবেল পুরষ্কার অর্জনের কিছু সময় পরেই হতাশা এবং বৃক্কে অসুস্থতা জনিত কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯১২ সালের অধিকাংশ সময়ই তিনি জনসম্মুখে আসা থেকে বিরত ছিলেন তবে তাঁর বান্ধবী ও সহকর্মী পদার্থবিদ হারথা আয়রটনের সাথে কিছু সময় ইংল্যান্ডে অতিবাহিত করেছেন। ১৪ মাস বিরতির পর অবশেষে ডিসেম্বর মাসে তিনি গবেষণাগারে ফিরে আসেন। ১৯১২ সালে ওয়ার্স সাইন্টিফিক সোসাইটি তাঁকে ওয়ার্সতে একটি নতুন গবেষণাগারের পরিচালকের পদে আসীন হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের উন্নয়ন যা শেষ হতে ১৯১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগেছিল এবং রু পিয়েরে-ক্যুরি নামে একটি নতুন সড়ক তৈরির পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকায় তিনি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ১৯১৩ সালে পোল্যান্ড ভ্রমণে আসেন এবং ওয়ার্স তাঁকে স্বাগতম জানায় কিন্তু রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ তাঁর ভ্রমণকে অবহেলার চোখে দেখে। একটি যুদ্ধ আসন্ন ছিল বিধায় অধিকাংশ গবেষককে ফরাসি সৈন্যে অন্তর্ভুক্ত করায় রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে। ১৯১৯ সালে এর কার্যক্রম পুরোদমে চালু হয়।
মৃত্যু
ক্যুরি ১৯৩৪ সালে শেষবারের মত পোল্যান্ড যান। এর অল্প কয়েক মাস পরে, ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই তারিখে হাউতে-সাভই এর প্যাজ্জি এর সাঞ্চেল্লেমজ স্যানাটরিয়ামে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অবর্ধক রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন; ধারণা করা হয় দীর্ঘদিন দীর্ঘক্ষণ তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে থাকায় তিনি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আয়নায়ন তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তাঁর আমলে জানা যায়নি। পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে এই সংক্রান্ত কাজ পরিচালিত হচ্ছে। তিনি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বিশিষ্ট পরীক্ষা নল (টেস্টটিউব) তাঁর কাপড়ের পকেটে বহন করতেন, এবং ওগুলো তাঁর ডেস্কের ড্রয়ারে সংরক্ষণ করতেন, অনুজ্জ্বল আলোর উপর নির্ভর করে যা অন্ধকারে বস্তুগুলো থেকে নির্গত হয়। যুদ্ধের সময়ে মাঠ হাসপাতালে তেজস্ক্রিয়তাবিদ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ক্যুরি উন্মুক্ত যন্ত্র থেকে আগত এক্স-রশ্মির সংস্পর্শেও এসেছিলেন। যদিও তিনি দশকের পর দশক তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসে বেশকিছু অন্তহীন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন (যার মধ্যে ছিল ক্যাটারাক্ট জনিত কারণে প্রায় অন্ধ হওয়া) এবং এক পর্যায়ে মৃত্যুও বরণ করেছিলেন, তিনি কখনো তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার স্বাস্থ্য ঝুঁকি বুঝতে পারেন নি।
তাঁকে সেকাউক্সের সমাধিস্থলে তাঁর জামাই পিয়েরের পাশে সমাহিত করা হয়। ৬০ বছর পর, ১৯৯৫ সালে তাঁদের অবদানকে সম্মান জানানোর অংশ হিসেবে উভয়ের দেহাবশেষ প্যান্থিওনে স্থানান্তর করা হয়। তিনি হয়ে যান প্রথম- এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী যিনি নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে প্যান্থিওনে সমাহিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।
তেজস্ক্রিয় দূষণের মাত্রার জন্য তাঁর যতগুলো গবেষণা পত্র ১৮৯০ সাল থেকে ছিল সেগুলো নাড়াচাড়া করা অত্যন্ত বিপজ্জনক মনে করা হয়। এমনকি তাঁর রান্নার বইও উচ্চ মাত্রায় তেজস্ক্রিয়। তাঁর গবেষণা পত্রগুলো সীসা-ঘেরা বাক্সে রাখা হয়েছে, এবং যারা সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে যাবেন তাঁদের অবশ্যই নিরাপদ কাপড় পরিধান করতে হবে।
জীবনের সর্বশেষ বছরে তিনি একটি বই লিখার কাজ করেছিলেন, তেজস্ক্রিয়তা, যা ১৯৩৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরপরই প্রকাশ করা হয়।
পদক, সম্মাননা ও শ্রদ্ধা
স্মরণকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী বৈজ্ঞানিক হিসেবে মারি ক্যুরি বৈজ্ঞানিক জগতের একজন আদর্শ এবং সারা বিশ্বে তিনি সম্মানিত হয়েছেন, এমনকি জনসংস্কৃতি থেকেও। নিউ সায়েন্টিস্ট কর্তৃক ২০০৯ সালে পরিচালিত একটি ভোটে ক্যুরি “বিজ্ঞানে সর্বাধিক উজ্জীবিতকারী নারী" নির্বাচিত হন। ক্যুরি মোট ভোটের ২৫.১ শতাংশ লাভ করেন যা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের প্রাপ্ত ভোটের (১৪.২ শতাংশ) প্রায় দ্বিগুণ।
পোল্যান্ড এবং ফ্রান্স ২০১১ সালকে মারি ক্যুরির বর্ষ ঘোষণা করেন এবং জাতিসংঘ একে রসায়নের আন্তর্জাতিক বর্ষ ঘোষণা করেন। স্যান ডিয়েগোর মিউজিয়াম অফ কনটেম্পোরারি আর্টের জ্যাকব গ্যালারী ‘মাদাম ক্যুরি’ পালন করতে বর্ণিল সাজে সেজেছিল। ৭ নভেম্বর তাঁর জন্মদিনে গুগল একটি বিশেষ Google Doodle দিয়ে তাঁর জন্মদিন উদযাপন করে। ১০ ডিসেম্বরে সুইডেনের রাজকন্যা মেডেলিনের উপস্থিতিতে নিউইয়র্ক একাডেমী অফ সাইন্স মারি ক্যুরির দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শততম বার্ষিকী উদযাপন করেন।
মারি ক্যুরি নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী, দুইটি নোবেল বিজয়ী প্রথম ব্যক্তি, দুইটি ক্ষেত্রে নোবেল জয়ী একমাত্র নারী এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে নোবেল পেয়েছেনতিনি যেসমস্ত পুরস্কার পেয়েছেন-
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (১৯০৩)
ডেভী পদক (১৯০৩, পিয়েরের সাথে)
মাট্টেউচ্চি পদক (1904; with Pierre)
এক্টোনিয়ান পুরস্কার (১৯০৭)
এলিয়ট ক্রেসন পদক (১৯০৯)
রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার (১৯১১)
ফ্রাঙ্কলিন মেডেল, আমেরিকান ফিলোসফিকাল সোসাইটি (১৯২১)
১৯৯৫ সালে নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রথম নারী হিসেবে তিনি প্যান্থিওন, প্যারিসে সমাধি লাভ করেন। ক্যুরি (প্রতীক Ci) নামক তেজস্ক্রিয়তার একক তাঁর এবং পিয়েরের সম্মানে রাখা হয়েছে (যদিও নামকরণ প্রদানকারী কমিশন কখনও পরিষ্কার করেনি যে এই নামকরণ পিয়েরে কিংবা মারি কিংবা দুইজনের সম্মানে করা হয়েছে কিনা)। ৯৬ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট মৌলের নামকরণ করা হয়েছিল কুরিয়াম। ক্যুরিদের নামে তিনটি তেজস্ক্রিয় খনিজ ও নামকরণ করা হয়েছে: কুরাইট, স্ক্লদভস্কাইট এবং কুপ্রোস্ক্লদভস্কাইট। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশকিছু অনারারি ডিগ্রী লাভ করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মারি ক্যুরি একশনস প্রবাসে কাজ করতে আগ্রহী তরুণ বিজ্ঞানীদের ফেলোশিপ প্রোগ্রাম। তিনি পজনান বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২২), কারকর জাগিয়েল্লোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২৪) এবং ওয়ার্স পলিটেকনিক (১৯২৬) থেকে অনারারি ডক্টরেট লাভ করেন। তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি ১৯২১ সালে আইওটা সিগমা পাই জাতীয় অনারারি সদস্যে ভূষিত হন।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থান তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। ২০০৭ সালে দুই ক্যুরির সম্মানে প্যারিসে একটি মেট্রোর নাম পরিবর্তন করে তাঁদের নামে রাখা হয়েছিল। পোলিশ নিউক্লিয়ার রিসার্চ রিএক্টর মারিয়া তাঁর নামে রাখা হয়েছে। ৭০০০ ক্যুরি গ্রহাণুটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। একটি কেএলএম ম্যাকডোনেল ডগলাস এমডি-১১ এর নাম (নিবন্ধন পিএইচ-কেসিসি) তাঁর নামে রাখা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাঁর নামে রাখা হয়েছে, যার শুরু দুইটি ইন্সটিটিউট দিয়ে– ওয়ার্সর মারিয়া স্ক্লদভস্কা-ক্যুরি ইন্সটিটিউট অফ অঙ্কলজি এবং প্যারিসের ইন্সটিটুট ক্যুরি। তিনি ফ্রান্সের অন্যতম বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় পিয়েরে অ্যান্ড মারি ক্যুরি ইউনিভার্সিটি (প্যারিস ৬) এবং ১৯৪৪ সালে লুবলিনে প্রতিষ্ঠিত মারি ক্যুরি-স্ক্লদভস্কা ইউনিভার্সিটিকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনে অসুস্থতার শেষ সীমার রোগীদের জন্য মারি ক্যুরি ক্যান্সার কেয়ার আয়োজন করা হয়। মারি ক্যুরিকে উৎসর্গ করে ২টি জাদুঘর আছে। ১৯৬৭ সালে ওয়ার্সর "নিউ টাউনে" উলিকা ফ্রেটা (ফ্রেটা সড়ক) অর্থাৎ মারি ক্যুরির জন্মস্থানে মারিয়া স্ক্লদভস্কা-ক্যুরি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্যারিসে তাঁর গবেষণাগারটি মিউজি ক্যুরি হিসেবে সংরক্ষিত যা ১৯৯২ সালে উন্মুক্ত করা হয়।
তাঁর প্রতিকৃতি হিসেবে অনেক চিত্রকর্ম তৈরি করা হয়েছে। ১৯৩৫ সালে পোলিশ প্রেসিডেন্ট ইগান্সি মজচিকের স্ত্রী মিচালিনা মজচিকা ওয়ার্সর রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের সামনে মারি ক্যুরির একটি প্রতিকৃতি বা মূর্তি উন্মুক্ত করেন। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নাৎসি জার্মানিদের বিরুদ্ধে ওয়ার্স জাগরণ ঘটে এবং গোলাগুলিতে প্রতিকৃতিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের পর প্রতিকৃতি ও এর পাদস্তম্ভে গুলির চিহ্ন রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে জোযেফ মাজুর কাচ দিয়ে মারি ক্যুরির প্রতিকৃতি মারিয়া স্ক্লদভস্কা-ক্যুরি মেডালিয়ন নির্মাণ করেন যা ইউনিভার্সিটি অফ বুফালোর পোলিশ রুমের বিশেষ আকর্ষণ।
তাঁকে উৎসর্গ করে বেশকিছু জীবনী লেখা হয়। ১৯৩৮ সালে তাঁর মেয়ে ইভ ক্যুরি মাদাম ক্যুরি প্রকাশ করেন। ১৯৮৭ সালে ফ্রাঙ্কইজ গিরৌড লিখেন মারি ক্যুরি: আ লাইফ। ২০০৫ সালে বারবারা গোল্ডস্মিথ লিখেন অবসেসিভ জিনিয়াস: দ্য ইনার ওয়ার্ল্ড অফ মারি ক্যুরি। ২০১১ সালে লরেন রেডনিজ প্রকাশ করেন রেডিওএকটিভ: মারি এবং পিয়েরে ক্যুরি, এ টেল অফ লাভ অ্যান্ড ফলআউট।
১৯৪৩ সালে গ্রির গারসন এবং ওয়াল্টার পিজন অস্কারের জন্য মনোনীত আমেরিকান চলচ্চিত্র মাদাম ক্যুরি (চলচ্চিত্র)-তে অভিনয় করেন। সাম্প্রতিককালে ১৯৯৭ সালে পিয়েরে ও মারি ক্যুরির উপর একটি ফরাসি চলচ্চিত্র উন্মুক্ত করা হয় যার নাম লেস পামেস ডি এম. সুতজ। এটি একই নামে একটি লিখিত একটি নাট্যগ্রন্থের উপর রচিত। এখানে ইসাবেলে হাপার্ট মারি ক্যুরির ভূমিকা পালন করেন।
লরেন্স আরনোভিচের ‘ফলস এজাম্পসন্স’ নাটকে মারি ক্যুরির ভূমিকা দেখা যায়, যেখানে অন্য তিন মহিলা বিজ্ঞানীর ভূত তাঁর জীবনের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে। সুসান মারি ফ্রন্তচজাক তাঁর এক-নারীর নাটক মানিয়া: দ্য লিভিং হিস্টোরি অফ মারি ক্যুরি-এ মারি ক্যুরিকে উপস্থাপন করেন যা ২০১৪ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি রাজ্য ও নয়টি দেশে প্রদর্শন করা হয়।
বিশ্বজুড়ে বিল, ডাকটিকিট এবং মুদ্রায় ক্যুরির ছবি দেখা গেছে। পোল্যান্ডে ১৯৮০ পরবর্তী সময়ের ব্যাংকনোট জিটটিতে মারি ক্যুরির ছবি দেখা গিয়েছিল এমনকি ইউরো প্রচলনের পূর্বে ফ্রান্সের সর্বশেষ ৫০০-ফ্রাংক নোটে ক্যুরির ছবি ছিল। দারুণ বিষয় হল মালি, টোগো প্রজাতন্ত্র, জাম্বিয়া, এবং গিনি প্রজাতন্ত্রে ডাকটিকিটে পল স্ক্রোডার পরিচালিত ২০০১ সালের ছবিতে সুসান মারি ফ্রন্তচজাকের মারি ক্যুরির ভুমিকায় অভিনয়ের দৃশ্য দেখা যায়।
২০১১ সালে মারি ক্যুরির দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তিতে ওয়ার্সতে তাঁর জন্মস্থানের সদর দরজায় একটি রূপক (বা প্রতীকী) দেয়ালচিত্র দেখা যায়। এতে দেখা যায় শিশু মারিয়া স্ক্লদভস্কা ক্যুরি একটি টেস্টটিউব ধরে ছিলেন যা থেকে দুইটি পদার্থ নির্গত হচ্ছিল যেগুলো তাঁর প্রাপ্তবয়স্কে আবিষ্কারের কথা: পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম।
এছাড়া ২০১১ সালে ভিস্তুলা নদীর উপর নতুন একটি ওয়ার্স ব্রিজের নাম তাঁর নামে রাখা হয়।