মিতু হত্যার ৩ মাস : তদন্তে ‘গোলকধাঁধার মারপ্যাঁচ’
প্রকাশ | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:১৩ | আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:৩১
পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম হত্যার ৩ মাস কেটে গেলেও পুরো ঘটনার রহস্য এখনো অজানা। পুলিশ বলেছিল, কামরুল সিকদার মুছাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে মামলার জট খুলবে। অন্যদিকে, পুলিশ অস্বীকার করলেও মুছার স্ত্রীর দাবি, পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে মুছাকে। আর এই দুই মাস ধরে মুছাতেই ‘আটকে’ আছে এ মামলার তদন্ত।
সোমবার (০৫ সেপ্টেম্বর) মাহমুদা হত্যার তিন মাস হতে চলেছে। গত ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড় এলাকায় মাহমুদা খানমকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় এসপি বাবুল আক্তার অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এই সময়ের মধ্যে এ মামলার বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো তথ্য দেননি বাবুল আক্তার।
গত ২৪ জুন মধ্যরাতে ঢাকার বনশ্রী এলাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে আবার বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এবিষয়ে পুলিশ জানায়, বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি। অবশ্য পরে বাবুল আক্তার বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য গত ৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে আবেদন করেছেন তিনি।
মাহমুদা হত্যায় জড়িত সন্দেহে প্রথমে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি মাজারের খাদেম আবু নছর গুন্নুকে গত ৮ জুন গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে একপর্যায়ে স্বীকার করে পুলিশ।
আবু নছরের স্ত্রী পারভীন আক্তার সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, ৩০ লাখ টাকা নিয়ে পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁর স্বামীকে এই মামলায় জড়িয়েছে। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে ১১ জুন শাহজামান রবিন নামের আরও এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মিতু হত্যার ২১ দিন পর ২৬ জুন গ্রেপ্তার করা হয় ওয়াসিম ও আনোয়ারকে। ওই দিন সকালে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ ইকবাল বাহার সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, মুছার নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এতে ওয়াসিম, আনোয়ারসহ সাত-আটজন অংশ নেন। এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া আবু নছর ও রবিন এই হত্যকাণ্ডে জড়িত এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পর ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁরা বলেন, মুছার নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু মুছা কার নির্দেশে এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, সে বিষয়ে তাঁরা কিছু বলেননি। জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডে ওয়াসিম, আনোয়ার, মোঃ রাশেদ, নবী, মোঃ শাহজাহান, মুছা ও মোঃ কালু অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে নবী ও রাশেদ গত ৪ জুলাই রাঙ্গুনিয়ায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলে ছিলেন ওয়াসিম, মুছা ও নবী। মাহমুদাকে ছুরিকাঘাত করেন নবী। অস্ত্র সরবরাহ করেন ভোলা। এঁদের মধ্যে মুছা ও কালুকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানায় পুলিশ।
মাহমুদা হত্যায় অস্ত্র সরবরাহ করা ভোলা ও তাঁর সহযোগী মনিরকে গত ২৭ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় পুলিশ গত ২৮ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু ভোলা অস্ত্র কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এবং কার নির্দেশে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন, তা তদন্তে বের করা যায়নি।
তিন মাসে মামলার অগ্রগতি কী জানতে চাইলে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তারা এখনোও বলে চলেছেন, মুছা ও কালুকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মুছা ধরা পড়লে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করা যাবে কী কারণে ভাড়াটে খুনিরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এদিকে একের পর এক কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন ভাবে। বাবুল আক্তারের পদত্যাগপত্রে ‘স্বাক্ষর’, পুলিশের ‘বক্তব্য’ এবং সম্প্রতি স্ত্রীকে নিয়ে বাবুল আক্তারের ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাস। সব প্রশ্ন তুলছে ভিন্নভাবে। বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যাচ্ছে বাবুল আক্তার ‘জড়িত’ থাকতে পারে। তবে পুলিশের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, কোনো এক ষড়যন্ত্রের শিকার বাবুল আক্তার নিজে এবং শুধুমাত্র দুই সন্তানের জন্য নিতে পারছেন না কোনো পদক্ষেপ। এমনকি সুযোগ নেই কিছু প্রকাশ করারও।
গুরুত্ব দিয়ে এই মামলার তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ ইকবাল বাহার বলেন, ‘বাদি বাবুল আক্তার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, কোনো তথ্যও দেননি তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে। বরং আমরাই তাঁর সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি অপরাধীদের শনাক্ত করতে।’ ঘটনায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে কি না—এই প্রশ্নে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘এখনো আমরা নিশ্চিত নই। সময় হলেই জানা যাবে।’
তিন মাসে একবারও স্ত্রী হত্যা মামলার খোঁজ না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাবুল আক্তার এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে গত ১৩ আগস্ট বাবুল আক্তার তাঁর ফেসবুকে স্ত্রী’র উদ্দেশ্যে সন্তানের বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘গোলকধাঁধার মারপ্যাঁচ বুঝার বয়স কী হয়েছে মায়ের মৃত্যুর সাক্ষী ছেলেটার?’ এ কথায় রয়েছে বিশ্লেষকদের ভিন্ন মতামত। তবে তদন্ত ওই ‘মুছাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে মামলার জট খুলবে’ বাক্যটিতেই আটকে রয়েছে।
এদিকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া খাদেম আবু নছরের স্ত্রী পারভীন আক্তারের দাবি, বিনা দোষে তাঁর স্বামীকে কারাভোগ করতে হচ্ছে। জামিনের আবেদন করা হলেও মঞ্জুর হচ্ছে না।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, মাহমুদা হত্যার তদন্তে শেষ পর্যন্ত আবু নছর ও রবিনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলে মামলা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হবে। এর আগে তাঁরা জামিন পাবেন কি পাবেন না, সেই এখতিয়ার আদালতের।