রাঙামাটিতে পাহাড়ধস
আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের দুই সমস্যা
প্রকাশ | ২১ জুন ২০১৭, ১৯:১৩ | আপডেট: ২১ জুন ২০১৭, ১৯:১৭
পাহাড়ধসে ঘর হারান রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী নতুন পাড়ার বাসিন্দা পারুল বেগম। তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় নেন শহরের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে। এখানে দুবেলা খাবার জুটলেও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শৌচাগার ব্যবহার আর পানি নিয়ে। এই কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৩৬৯ জন। শৌচাগার রয়েছে কেবল দুটি। দিনের বেশির ভাগ সময় পানি থাকে না। এতে নারীদের বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
পারুল বেগম বলেন, এই আশ্রয়কেন্দ্রে যত লোক উঠেছে তাদের অর্ধকের বেশি নারী ও শিশু। শৌচাগার ব্যবহারের জন্য লাইন দিয়ে থাকতে হয়। গোসল করার ব্যবস্থা নেই। আধা কিলোমিটার হেঁটে পাশের নতুন পাড়ায় একজনের বাড়িতে গিয়ে গোসল করেন তিনি। অন্য নারীদেরও গোসল করতে একই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ছাড়া খাওয়ার পানির জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের সবাইকে পৌরসভার গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে হয়।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। এক বছর বয়সী ছোট ছেলের খাবার নিয়েও সমস্যায় আছেন পারুল বেগম। আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুদের জন্য আলাদাভাবে খাবারের ব্যবস্থা নেই। পারুল তার ছেলের জন্য বাইরের দোকান থেকে সাধ্যমতো টুকটাক খাবার কিনে এনে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন।
পাহাড়ধসে স্বজন, সহায়-সম্বল হারানো দুর্গত মানুষের জন্য রাঙামাটিতে ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে জেলা প্রশাসন। এসব কেন্দ্রে মোট ২ হাজার ৮৪১ জন থাকছে। ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৭টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে এসব আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খোলা হয়েছে। অস্থায়ী এসব আশ্রয়কেন্দ্রের কোনোটিতেই পর্যাপ্ত শৌচাগার ও পানির ব্যবস্থা নেই।
গতকাল ২০ জুন (মঙ্গলবার) রাঙামাটি শহরের চারটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তারা বলেন, পুরুষের চেয়ে শিশু ও নারীদের বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
রাঙামাটি শহরের বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে ৩২৬ জন। আশ্রিতদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু। আশ্রয়কেন্দ্রটিতে শৌচাগারের সংখ্যা সাতটি। এর মধ্যে নারী ও শিশুর জন্য বরাদ্দ চারটি শৌচাগার। কিন্তু বরাদ্দ থাকলে কী হবে, পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নেই।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া পারুল বেগম যেসব সমস্যার কথা বলেছেন বিএডিসিতে আশ্রয় নেওয়া শহরের লোকনাথ মন্দির এলাকার হালিমা বেগমের সমস্যাও একই রকমের। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত পানি না থাকায় গোসলের জন্য তাকে পরিচিত কারও বাসায় যেতে হয়। খাওয়ার পানি নিয়েও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাকে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বেলা দেড়টায় পৌরসভার একটি পানির গাড়ি আসে কেন্দ্রে। পানির গাড়ি দেখেই তা সংগ্রহ করতে হুড়োহুড়ি লেগে যায় নারী-পুরুষ সবার মধ্যে।
বিএডিসির পাশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা মিলেছে ২৪টি পাহাড়ি পরিবারের। ছয়টি কক্ষে ৮৭ জনকে থাকতে হচ্ছে। এদের মধ্যে ৪৫ জনই নারী ও শিশু। এত মানুষের জন্য শৌচাগার কেবল একটা। এই কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া নারীদের একজন বিদ্যানগর এলাকার গৃহহারা রীতা চাকমা। স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে ১৩ জুন দুর্যোগের দিন এই আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন তিনি।
রীতা চাকমা বলেন, জায়গা কম হওয়ায় রাতে ঘুমে সমস্যা হয়। নারীদের জন্য আলাদা কোনো শৌচাগার না থাকায় সমস্যা হচ্ছে। গতকাল দুপুরে এখানে খাবার হিসেবে দেওয়া হয় খিচুড়ি। সকালে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি।
অঞ্জনা চাকমা নামের এক নারী বলেন, সকালে শিশুদের জন্য নিজ উদ্যোগে খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন উপকেন্দ্রের আশ্রয়শিবিরে পানির কোনো ব্যবস্থাই নেই। পাহাড়ধসে কেন্দ্রটির পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে ১৭০ জন নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে। শৌচাগার মাত্র দুটি। ওই কেন্দ্রে থাকা শহরের ভেদভেদী রূপনগর এলাকার নাসরিন আক্তার বলেন, বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে। রাতে মশার জন্য ঘুমাতে কষ্ট হয়।
কেন্দ্রটির দায়িত্বে রয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এ বিষয়ে সোসাইটির যুব উপপ্রধান সাইফুল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বাইরে থেকে পানি এনে শৌচাগারে দেওয়া হচ্ছে। খাবার পানিও আনা হচ্ছে পৌরসভা থেকে।
আশ্রয়কেন্দ্রের এসব সংকট সাধ্যমতো সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানান রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান। তিনি বলেন, পানি সংরক্ষণের জন্য মঙ্গলবার থেকে প্রতিটি পরিবারকে একটি ১০ লিটারের পানির জার দেওয়া হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর জন্য ৯০টি ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার চালু করা হচ্ছে। অতিরিক্ত পানির ট্যাংকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিশুদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা কয়েকটি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে গতকাল শিশুসহ প্রায় ১০ জন অসুস্থ ছিল। বেলা ১১টায় একজন চিকিৎসক এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন এবং ওষুধ দেন।
১৩ জুন পাহাড়ধসের পর থেকে গত সোমবার পর্যন্ত রাঙামাটিতে ১১৮ জনের প্রাণহানির তথ্য প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসন। সব মিলিয়ে পাহাড়ধসের ঘটনায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই পাঁচ জেলায় ১৫৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
গতকাল বিকেলে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ বিতরণ নিয়ে ফেসবুকে কেউ কেউ উসকানি দিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রশাসন ত্রাণ বিতরণে পাহাড়ি-বাঙালি ভেদাভেদ করেনি।
এদিকে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের সাপছড়ি শালবাগান এলাকায় বিলীন হয়ে যাওয়া সড়কের প্রায় দেড় শ মিটার অংশের মেরামতের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এমদাদ হোসেন। তিনি বলেন, আজ ২১ জুন (বুধবার) থেকে ওই স্থান দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে হালকা যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
সূত্র: প্রথম আলো