‘এই অপমান আমাদের সবার’
প্রকাশ | ১৭ মে ২০১৬, ২২:৩২ | আপডেট: ১৭ মে ২০১৬, ২২:৫৭
মসজিদের মাইকে ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে নারায়নগঞ্জে স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে জনসমক্ষে অপমান করার প্রতিবাদে এবং নির্যাতক সেলিম ওসমান এর শাস্তির দাবিতে ১৭ মে সোমবার বিকেল ৫টায় শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-শিক্ষার্থী-সাংস্কৃতিক কর্মীবৃন্দ।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহ’র সঞ্চালনায় বিক্ষোভ সমাবেশে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে একজন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তুলে তাকে সবার সামনে কান ধরে উঠবস করানোর তীব্র প্রতিবাদ করেন বক্তারা। একই সাথে এই জঘন্য ঘটনা ঘটানোর জন্য সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের বিচার দাবি করেন তারা।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, আজ সমাজে এতই অধঃপতন হয়েছে যে একজন শিক্ষককে কান ধরে সবার সামনে উঠবস করানো হচ্ছে আর তা দেখে উল্লাসে জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছে কিছু মানুষ। কেউ যদি অন্যায় করে থাকেন সেক্ষেত্রে তার শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য আইন রয়েছে, বিচার বিভাগ রয়েছে। কিন্তু এসবকিছুর তোয়াক্কা না করে একজন সংসদ সদস্য কোন অধিকার বলে একজন শিক্ষককে অপমান করেন?
এছাড়া মৌলবাদীদের হাতে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যা, বাগেরহাটের চিতলমারীতে দুই শিক্ষক বরখাস্ত, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ফেসবুকের পোস্টের জন্য এক মেয়েকে গ্রেফতার, টাঙাইলে সন্ত্রাসীদের হাতে দর্জি খুন, নাইক্ষ্যাংছড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যা, সেনানিবাসে তনু ধর্ষণ ও হত্যা সহ সারা দেশে চলমান সব ধর্মীয় সন্ত্রাস, হত্যাকান্ড ও অন্যায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান বক্তারা।
সমাবেশে আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, “কোন অপরাধ সংঘটিত হলে এখন আর অপরাধীর নয় বরং যিনি ভিক্টিম তার অপরাধই আগে খতিয়ে দেখা হয়। লেখালেখির জন্য কেউ নিহত হলে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন তিনি কি লিখতেন তা খতিয়ে দেখা হবে। এখনো আমরা দেখছি যে সাংসদ এরকম অন্যায় কাজ করেছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সেই শিক্ষক এর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এই অপমান একজন শিক্ষকের নয়, বরং গোটা জাতির, আমাদের সবার।”
আইনজীবী ও বাম রাজনীতিবিদ হাসান তারিক চৌধুরী বলেন, “বর্তমান আওয়ামী সরকার ও বিএনপি জামায়াত এর মধ্যে এখন আর কোন পার্থক্য নেই। বর্তমানে সারাদেশে ধর্ম অবমাননার নামে যে সন্ত্রাসবাদ ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে তা এই সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনেই হচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটেছে কিন্তু বিচার হয়নি। আজ একজন সংসদ সদস্য আইনের তোয়াক্কা না করে একজন শিক্ষককে অপমান করছেন। কিন্তু আমরা জানি এই ঘটনারও বিচার হবে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন”।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরিন বলেন, “এই শিক্ষকের মাঝে আমরা সবাই আমাদের নিজেদের খুঁজে পেয়েছি, যেখানে অন্যায় না করেও ক্ষমতাবানদের হাতে আমাদের সবার সামনে অপমানিত হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই আজ এই শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত আমাদের সকলেরই প্রতিচ্ছবি।”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “১৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করেও শ্যামল কান্তি ভক্ত তার একজন ছাত্রকেও মানুষ করতে পারলেন না। যদি পারতেন তবে তারা তাদের শিক্ষকের এই অপমান সহ্য করতো না।”
তিনি বলেন, “আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বলছি শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যদি সত্যিও হয়ে থাকে তবে তার জন্য আমাদের দেশের প্রচলিত ধারাতেই আইন রয়েছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় একজন বাদী হয়ে অভিযোগ করেন, একজন বিচারক বিচার করেন আর আরেকজন শাস্তি দেয়। কিন্তু সাংসদ সেলিম ওসমান একাই এই ৩টি দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এই বিচার ব্যবস্থার কি প্রয়োজন?”
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ এর সভাপতি লাকী আক্তার বলেন, “আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে ঐ শিক্ষক এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা। সেই শিক্ষার্থী নিজেই স্বীকার করেছে যে শিক্ষক শ্যামল কান্তি তার ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেননি। মূলত ম্যানেজিং কমিটির ষড়যন্ত্রেই প্রধান শিক্ষক পদ থেকে সরানোর জন্য এই মিথ্যে নাটক সাজানো হয়। আর এতে যোগ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের ত্রাস গডফাদার ওসমান পরিবারের সেলিম ওসমান”।
ওসমান পরিবারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এটাই প্রথম নয়, আমরা এর আগেও দেখেছি এই গডফাদার পরিবার কিভাবে ত্বকিকে হত্যা করেছে। পুত্রের হত্যার বিচার দাবি করায় এরা ত্বকির পিতা রফিউর রাব্বিকেও হুমকি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায়ও এরা জড়িত। তবু আমাদের প্রধানমন্ত্রী এদের পক্ষে অবস্থান নেন”।
উদীচীর কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পর জয় বাংলা স্লোগান আমরা হারিয়েই ফেলছিলাম। এই শাহবাগ সেই স্লোগানকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। অথচ একজন শিক্ষককে অপমান করার সময় আমরা সেই জয় বাংলা ধ্বনি শুনি। এটা মুক্তিযুদ্ধের অপমান। একজন শিক্ষক নয় বরং কান ধরে উঠবস করছে আজ সারা বাংলাদেশ। এমন নিকৃষ্ট ঘটনার প্রতিবাদ শুধু ঢাকায় নয় সারাদেশে প্রত্যেকটি জেলায় উপজেলায় হওয়া উচিত”।
মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, “আমি আশ্চর্য হবো না যদি আমি জানতে পারি যে মসজিদে মাইকে গুজব ছড়ানোর পেছনেও ঐ সাংসদ জড়িত”।
মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও শালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, “শ্যামল কান্তি ভক্ত কোন অন্যায় করেননি। তাই তার লজ্জিত কিংবা বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। লজ্জিত হওয়া উচিত সেলিম ওসমান ও তার সহচরদের। মুখ ঢেকে দেয়া উচিত তাদের”।
প্রতিবাদ সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা ফিরোজ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক, শিল্পী কফিল আহমেদ, সাংবাদিক নেতা পুলক ঘটক, লেখক ও গবেষক দীপঙ্কর গৌতম, আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত, গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা সহিদুল ইসলাম সবুজ প্রমুখ।
সমাবেশ শেষে আয়োজকদের পক্ষে সরকারের কাছে ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান। ৫ দফা দাবি হচ্ছে,
১. সাংসদ সেলিম ওসমান ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির দোষী সদস্যদের গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে।
২. শ্যামল কান্তি ভক্ত এর বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে পুনর্বহাল এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা ইউনিয়নের দণ্ডপ্রাপ্ত দুই শিক্ষকের মুক্তি ও তাদের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার এবং পুনর্বহাল করতে হবে।
৪. ধর্মীয় উস্কানী প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. সারাদেশে ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, পুরোহীত, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও বৌদ্ধভিক্ষু হত্যার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।