হালিমই ধর্ষক 'নাঈম আশরাফ'
প্রকাশ | ১১ মে ২০১৭, ১৫:২৫ | আপডেট: ১১ মে ২০১৭, ১৮:১০
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্দাইল গ্রামে জন্ম নেওয়া এইচএম হালিম ঢাকায় গিয়ে নাম বদলে হয়েছে নাঈম আশরাফ। প্রকৃতপক্ষে সে একজন প্রতারক। স্কুলজীবন থেকেই এ কাজে তার হাতেখড়ি। বাবার নাম বদল করে বিয়ে করেছে ৩টি। আগের ২ স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার কালসি এলাকায় ভাড়াবাড়িতে চলছে তার সংসার।
কাজিপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে না থেকেও ব্যবহার করছে দলীয় পদ। দলের শীর্ষ নেতাদের ছবি দিয়ে লাগিয়েছে ব্যানার-ফেস্টুন।
বনানীর হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় মিডিয়ায় ছবি প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে তার জন্মভূমির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ। কথিত নাঈম আশরাফের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্দাইল গ্রামে গেলে এমন চিত্রই উঠে আসে।
প্রতিবেশী সিএনজি চালক শামীম হোসেন জানান, ২০০৪ সালে গান্দাইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এইচএম হালিম (হাসান মোহাম্মদ হালিম)। এই স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পরিচয় ব্যবহার করে রাজশাহী বোর্ড থেকে প্রশ্ন এনে ফেঁসে যায় সে। এরপর ভর্তি হয় বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে।
সেখানে পড়াশুনা করা অবস্থায় সিরাজগঞ্জ শহরের এক প্রভাবশালী ঠিকাদারকে নিজের বাবা পরিচয় দিয়ে বিত্তশালী পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করে। পরিচয় জানার পর মেয়ে পক্ষ হালিমকে মারপিট করে মেয়েকে ছাড়িয়ে নেয়। আর বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ তাকে কলেজ থেকে বের করে দেয়। এরপর সে ঢাকা তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে ডিপ্লোমা পাস করে।
হালিমের এক ঘনিষ্ঠজন বলেন, ইলেক্ট্রিক্যাল বিষয়ে ডিপ্লোমা পাস করার পর হালিম একুশে টিভিতে যায় ইন্টার্নি করতে। এরপর সেখানেই ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে তার চাকরি হয়। চেক জালিযাতি করার কারণে তার চাকরি চলে যায়। পরে মোহনা টিভিতে একই পদে চাকরি নেয়। সেখানেও একই কারণে সে চাকরিচ্যুত হয়। ভাড়াটিয়া হিসাবে বসবাস করে ঢাকার কালসি এলাকার সাংবাদিক কলোনির পশ্চিম অংশে অবস্থিত এক্সটেনশন রূপপুরের ৪নং গলিতে ৫ তলা ভবনের ৩য় তলার পিছনের অংশের একটি ফ্ল্যাটে।
প্রতিবেশী ও স্থানীয় সীমান্ত বাজারের পানের দোকানি আবু সাঈদ জানান, হালিম জীবনে বহু মানুষকে নিজের বাবা বানিয়ে অকাম-কু-কাম করেছে।
কাজিপুর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোজাহারুল ইসলাম জানান, হালিম ছোট থেকেই এলাকায় থাকেনি। দলের মিছিল-মিটিংও করেনি। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি পদ ব্যবহার করে এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুন লাগানোর পর যুবলীগের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগও করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই ব্যানার-ফেস্টুনগুলো এখনও অপসারণ করা হয়নি।
কাজিপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হুদা মিষ্টি জানান, নাঈম আশরাফই আসলে হাসান মোহাম্মদ হালিম। দলের কমিটিতে আবদুল হালিম নামে যার নাম রয়েছে, সে আসলে এই হালিম নয়। কমিটিতে এই হালিমের কোনো নাম নেই। নিজের ইচ্ছায় চিটারি করে ব্যানারে সে নিজের নাম ও পদবি ব্যবহার করছে।
কাজিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল আমিন বলেন, ছোট থেকেই হালিম প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। বাবা-মা ও নিজের নাম বদল করে এর আগেও সে বেশ কয়েকটি অপকর্ম করেছিল। যার দেনদরবার আমরাও করেছি। ওর বাবা আমজাদ হোসেন একজন দিনমজুর। ফেরি করে থালা-বাটি বিক্রি করতেন। করেছেন কৃষি কাজও।
প্রতিবেশী যাটোর্ধ্ব শাহিদা বেগম জানান, ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পর টিভিতে যখন নাঈম আশরাফ নাম বললো, তখন আমরা বিষয়টি বুঝতে পারিনি। যখন ছবি দেখালো তখনই বুঝলাম এত আমাদের হালিম।
হালিমের বাড়িতে গিয়ে তালাবদ্ধ টিনশেড বসতঘর পাওয়া গেলেও তার বাবা-মাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। কথা হয় তার দিনমজুর ছোট চাচা আবুবক্কার সিদ্দিক ও চাচী মাহমুদা খাতুনের সঙ্গে। পত্রিকায় ছাপানো ছবি দেখে তারা নিশ্চিত করেন এটাই হালিম। নাঈম আশরাফ প্রসঙ্গে তারা কিছু জানেন না।
চাচী মাহমুদা খাতুন বলেন, বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হালিম দীর্ঘ ৫ বছর বাড়িতে আসে না। কিছুদিন হলো সে তার বাবা-মাকে ঢাকায় নিয়ে গেছে। বাড়ির সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। বসতবাড়ি ও আবাদি জমি মিলে ১৭ শতক জায়গা আছে হালিমদের। আগে হালিমের বাবা ফেরি করে থালা-বাটি বিক্রি করতো। কৃষি শ্রমিক হিসাবেও মাঠে কাজ করেছেন। মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর আমরা জানতে পেরেছি ঢাকায় হালিমের ঝামেলা হয়েছে। এর আগে সে ধানমন্ডিতে বিয়ে করেছিল। সে বউ চলে যাবার পর বরিশালের এক মেয়েকে বিয়ে করে এখন সংসার করছে। এক প্রশ্নের উত্তরে ধর্ষণের ঘটনা সত্য হলে ভাতিজার শাস্তি দাবি করেন হালিমের চাচা-চাচী।
স্থানীয় গান্দাইল ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আশরাফুল আলম বলেন, হালিম নাম পরিচয় গোপন করে ছাত্র অবস্থায় বগুড়ায় ও ১ বছর আগে সে ঢাকার মোহাম্মদপুরে এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল, যে দরবার আমি নিজেও করেছি। সে বছরে ২/১ বার এলাকায় আসে। প্রতারণাই তার পেশা। স্কুল জীবন থেকেই সে প্রতারক। আমার কাছেও তার বিরুদ্ধে লোকজন অভিযোগ করেছে। কিন্তু এলাকায় না থাকায় তার বিচার করতে পারছি না। ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত থাকলে আমরা তার শাস্তি দাবি করছি।