আইনজীবী প্রতারণা করলে প্রতিকার কী?
প্রকাশ | ১২ মার্চ ২০১৭, ১০:২০
আইনজীবী প্রতারণা করলে কী করবেন?
থানায় বা আদালতে একজন নাগরিক নিজেই নিজের মামলা ও অন্যান্য আইনি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু আইন-আদালত সম্পর্কে যথেষ্ট জানার অভাব থাকায় প্রায় সবাই আইনি কাজে শরণাপন্ন হন কোনো আইনজীবীর। এই আইনজীবীই যখন তার মক্কেলের সঙ্গে পেশাগত প্রতারণা ও অসদাচরণ করে বসেন, তখন ভুক্তভোগীর প্রতিকার কী?
দৃশ্যপট-১
জহির সাহেবের জমি অর্পিত সম্পত্তির তফসিলে চলে আসায় তিনি ঢাকার দেওয়ানি আদালতে মামলা করেছেন। তার দাবি, ভুলবশত তার এই জমিকে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এক দালালের খপ্পরে পড়ে জহির সাহেব এই আদালতের এক আইনজীবীর শরণাপন্ন হয়েছেন এবং তিনিই বর্তমানে এই মামলা পরিচালনা করছেন।
প্রতি মাসেই মামলার তারিখ পড়ে। জহির সাহেব সেই মোতাবেক আদালতে হাজিরও হন। কিন্তু তার আইনজীবী অযথাই আদালতে অনুপস্থিত থাকেন। নিজ চেম্বারে বসে থেকে তিনি তার অনুজ আইনজীবীকে আদালতে পাঠান সময়ের আবেদন নিয়ে। এভাবেই অযথা কালক্ষেপণ করে যাচ্ছেন জহির সাহেবের আইনজীবী। প্রতি তারিখে আবার তার কাছ থেকে বিভিন্ন অসিলায় টাকাও আদায় করেন সেই আইনজীবী।
দৃশ্যপট-২
মুকুল সাহেবকে নারী নির্যাতন মামলার আসামি করে মামলা দিয়েছে তার প্রতিবেশী সেলিম। সেই মামলায় মুকুল সাহেবকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। সাধারণত এই আইনে সংঘটিত অপরাধ জামিনের অযোগ্য। মুকুল সাহেব গত দুই মাস থেকে বন্দি। বিষয়টি নিয়ে তার পরিবার দারুণ চিন্তিত।
এদিকে আইনজীবী মারফত মুকুল সাহেবের স্ত্রীকে জানানো হয়েছে, আগামী মাসে জামিন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ জন্য বিচারক ও পেশকারকে তিন লাখ টাকা ঘুষবাবদ দিতে হবে। এর আগেও এক লাখ টাকা এই আইনজীবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন মুকুল সাহেবের স্ত্রী। কিন্তু জামিন পাওয়া যায়নি।
দৃশ্যপট-৩
আমান সাহেবের জমি দখল করেছে ভূমিদস্যু কিসিমের এক ডেভেলপার কোম্পানি। তিনি এই অন্যায় দখলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলায় সবকিছু তার পক্ষেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এক সময় তিনি লক্ষ্য করতে থাকেন, তার আইনজীবী আদালতে তাকে ঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন না।
মামলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতের দৃষ্টিগোচর করার দিকে মনোযোগী হচ্ছেন না। আমান সাহেব ভালো করে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে তার আইনজীবীর এক ধরনের আঁতাত হয়েছে। এ কারণেই তার মামলাকে দিন দিন দুর্বল করে দিচ্ছে তার আইনজীবী।
আইনজীবীর কাছ থেকে এ ধরনের পেশাগত অসদাচরণ ও প্রতারণার অভিযোগ অনেক সময়ই পাওয়া যায়। আমাদের সমাজে এরকম বহু মানুষ পাওয়া যাবে, যারা মামলা চালাতে গিয়ে অসৎ আইনজীবীর পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এর কারণ হলো- যে মহান নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই পেশার উদ্ভব, বর্তমান যুগে অনেক আইনজীবীই সেই একাগ্রতা ও সততার চূড়ান্ত উৎকর্ষতা থেকে বিচ্যুত।
দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, জামিনের বা বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দেয়ার নাম করে টাকা খাওয়া, শুনানির দিনে উপস্থিত না হওয়া, ব্যস্ততা দেখিয়ে মক্কেলকে ঘোরানো, বিপক্ষের সঙ্গে লেনদেন করা কিংবা নিজ মক্কেলের সঙ্গে প্রতারণার মতো বিষয়গুলোর শিকার হচ্ছেন অনেক অসহায় বিচারপ্রার্থী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা বিচারের আশায় নীরবে এই নিগ্রহ সহ্য করে যান। অনেকেই আবার মুখ খুলতে চান না ভয়ে কিংবা জানেনই না যে আইনে এর প্রতিকার রয়েছে। অথচ এই অবস্থার শিকার যে কেউই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রতিকার পেতে পারেন।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
আইনজীবীদের পেশার সনদ প্রদান ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হলো বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। নতুন আইনজীবীদের তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা গ্রহণ, আইনজীবীদের পেশাগত আচরণের জন্য নীতিমালা নির্ধারণ, সব আইনজীবীর কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ, আইন পেশার মান রক্ষা এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিচার করে থাকে এ প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭২ সালের ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার’ দ্বারা বার কাউন্সিলের গঠন, নির্বাচন ও পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হয়। আইনজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ‘দ্য বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার অ্যান্ড রুলস, ১৯৭২’ এবং ‘ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্টে’ উল্লেখ আছে।
বার কাউন্সিলের পরিচালনার জন্য একটি পর্ষদ রয়েছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকারবলে এই সংস্থার প্রধান। তবে আইনজীবীদের পেশাগত আচরণের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কাছে ততটা পরিচিত নয় এবং সে কারণে ভুক্তভোগী বিচার প্রার্থীরাও জানেন না যে পেশাগত অসদাচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে এখানে অভিযোগ দায়ের করতে হয়।
অভিযোগ করার প্রক্রিয়া
কোনো আইনজীবীর অসদাচরণের কারণে যে কোনো ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে তিনি বার কাউন্সিলের সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। বার কাউন্সিল সাধারণত সংক্ষিপ্ত শুনানিতে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির মতো বিষয়গুলো উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হয়। তবে অভিযোগ গুরুতর হলে বা সমাধান না করা গেলে বার কাউন্সিল তা বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়। দ্য বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২-এর ৩৩ ধারা মোতাবেক এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত।
ট্রাইব্যুনালে বিচার ও শাস্তি
ভুক্তভোগী কোনো ব্যক্তির অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বার কাউন্সিলে বর্তমানে পাঁচটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল থেকে দেয়া আদেশ হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের মতো কার্যকর হবে। একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্যের সমন্বয়ে একেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত। এই তিনজনের দুজন বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য এবং আরেকজন তালিকাভুক্ত আইনজীবী। তিনজনের মধ্যে যিনি অগ্রজ, তিনিই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে কোনোক্রমেই অ্যাটর্নি জেনারেল বসতে পারেন না। কোনো আদালত বা মক্কেল থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগের তদন্ত করে ৩৪ ধারা মোতাবেক শুনানির ব্যবস্থা করবে এবং তদন্ত ও শুনানিতে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হলে ৩২ ধারা মোতাবেক তা নিষ্পত্তি করে দেবে আর প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে তিরস্কার করাসহ তার সদস্যপদ স্থগিত অথবা সমিতি থেকে বহিষ্কার করার মতো শাস্তি প্রদান করার বিধান রয়েছে। সদস্যপদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ঠিক কত দিন স্থগিতাদেশ কার্যকর থাকবে, তার একটি মেয়াদ নির্ধারণ করে দেবে ট্রাইব্যুনাল। তবে শাস্তির প্রকার নির্ভর করে অভিযুক্ত ব্যক্তি কত গুরুতর অপরাধ করেছে তার ওপর। তবে কেউ যদি মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অভিযোগ করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে ৫০০ টাকা দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ওই ট্রাইব্যুনালেই রিভিউ আবেদন করতে পারে। এ ছাড়া যে কোনো পক্ষ নিজেকে সংক্ষুব্ধ মনে করলে ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে পারবে। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।