মুসলিম আইনে ভরণপোষণ স্ত্রীর আইনগত অধিকার
প্রকাশ | ১২ মার্চ ২০১৭, ০৯:১৫ | আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৭, ০৯:২৯
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী ভরণপোষণ বলতে জীবিকা নির্বাহের জন্য খাওয়া, পরা ও থাকার সংস্থানকে বোঝায়। মাঝে মাঝে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করাকে ভরণপোষণ বলে না। শুধুমাত্র খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান হলেই ভরণপোষণ সংজ্ঞাটি সম্পূর্ণ নয়। শিক্ষার খরচ এবং শরীর ও মানসিক পুষ্টির জন্য যাবতীয় বিষয়ও এই সংজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হবে। স্বামী যতই গরীব হোক না কেন, তাতে স্ত্রীর অধিকার নষ্ট হয় না। স্ত্রীর খোরপোষ স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক। স্বামীর এ দায়িত্ব ব্যক্তিগত। তবে স্ত্রীর খোরপোষ বা ভরণপোষণ শর্তসাপেক্ষে।
ভরণপোষণের শর্ত
১. স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। স্ত্রীও ভরণপোষণ পেতে হকদার।
২. স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে অভ্যাসগতভাবে খারাপ ব্যবহার করে, গৃহত্যাগের নির্দেশ দেয়, তাড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে থাকে অথবা তাদের মধ্যেকার আচার আচরণ এরুপ পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এটা নিরসন করা সম্ভব নয় বা স্বামীর গৃহে থাকলে আরও অসুবিধা এবং বিরোধের জন্ম দিবে, সে অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে বসবাস না করেও খোরপোষ দাবি করতে পারে।
৩. স্ত্রী তার আশু দেনমোহর দাবি করলে উক্ত দেনমোহর স্বামী পরিশোধ না করলে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে পৃথক বসবাস করতে থাকলেও স্বামী তার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে।
স্ত্রী কখন ভরণপোষণ পাবে না
১. স্ত্রী স্বামীর নিষেধাজ্ঞা সত্ব্ওে যেখানে স্বামী অবস্থান করে সেকানে ভিন্ন অন্যত্র বসবাস করলে।
২. স্ত্রী বন্দিদশায় থাকলে। তবে স্বামী বন্দিদশায় থাকলে স্ত্রী ভরণপোষণ হতে বঞ্চিত হবে না।
৩. স্ত্রী অন্যায়ভাবে অবাধ্য হয়ে স্বামীর অনুমতি ছাড়া অসংগত কারণে স্বামীর গৃহ ত্যাগ করলে।
৪. সংগত কারণ ছাড়া স্ত্রী স্বামী হতে থাকলে
৫. স্ত্রী ধর্মত্যাগ করলে
৬. স্ত্রীর অবাধ্যাচারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে।
৭. স্বামীর মৃত্যুজনিত কারণে ইদ্দত পালনরত থাকলে; তবে শর্ত হলো যে, বিধবা অন্তঃসত্তা হলে গর্ব খালাস না অবধি খোরপোষ পাবে।
৮. স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে।
ভরণপোষণ পরিশোধের নিয়ম
১. ৯ ধারার বিধান অনুসারে সালিশী পরিষদ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে উপযুক্ত খোরপোষ উল্লে¬খ করে প্রত্যয়নপত্র প্রদান করবে।
২. বিবাহ যতদিন বলবৎ থাকবে, ততদিনই স্বামী খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকবে।
৩. খোরপোষের পরিমাণ নির্ধারণ করার সময় সালিশী পরিষদ স্ত্রীর পরিবারের সামাজিক পদমর্যাদা, স্বামীর উপার্জন এবং অন্যান্য বিষয়াবলীও বিবেচনা করে খোরপোষের পরিমাণ নির্ধারণ করবে।
৪. স্ত্রীকে এমন পরিমাণ খোরপোষ মঞ্জুর করতে হবে যা দ্বারা স্ত্রী ঠিকমত জীবন-যাপন করতে পারে।
ভরণপোষণ আদায় ও স্থানীয় সালিশী পরিষদের ভুমিকা
১. কোনো স্বামী তার স্ত্রী/স্ত্রীগনকে সমান খোরপোষ না দিলে স্ত্রী/স্ত্রীগন ভরণপোষণ আদায়ের জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে পারবে। চেয়ারম্যান বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবে।
উক্ত সালিশী পরিষদ স্বামী কর্তৃক খোরপোষ হিসাবে দেয় টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করতে পারবে।
স্বামী অথবা স্ত্রী নির্ধারিত পদ্ধতিতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটটি পুনঃবিবেচনার উদ্দেশ্যে সহকারী জজের নিকট আবেদন করতে পারবে এবং এক্ষেত্রে সংশ্লি¬ষ্ট সহকারী জজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে এবং এর বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
২. উপরোক্ত রুপে দেয় কোন অর্থ যথাসময়ে প্রদান করা না হয়ে থাকলে এটা বকেয়া রাজস্বের আকারে আদায়যোগ্য হবে।
৩. উপরোক্ত কোন শর্ত ভঙ্গ করলে, চেয়ারম্যান কর্তৃক সালিশী পরিষদের সিদ্ধান্ত না মানলে এবং আদালতের নিয়ম নির্দেশ অমান্য করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় নিতে পারে।
সন্তানের ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব মুসলিম আইন ও রাষ্টীয় আইন অনুসারে পিতাই সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক। তাই সন্তানের ভরণপোষণের সমস্ত দায়-দায়িত্ব হচ্ছে বাবার।
ক) সাবালক প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পিতা তার ছেলে-মেয়েদের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
খ) তালাক বা বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকে, তবুও বাবাই ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে ছেলে ৭ বৎসর এবং মেয়ের বিবাহ হওয়া পর্যন্ত। উল্লেখ্য যে, মেয়ের বিয়ের খরচও বাবাকেই দিতে হবে।
গ) যদি কোন সাবালক সন্তান অসুস্থতার জন্য কিংবা পঙ্গুত্বের জন্য রোজগার করতে না পারে, তবে বাবা তাকে আজীবন ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
ঘ) পিতা-মাতা গরীব বা দৈহিকভাবে অসমর্থ হলে দাদার অবস্থা সচ্ছল হলে ওই সকল ছেলে-মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব দাদার উপর ন্যস্ত হবে।
ঙ) সন্তানদের অভিভাবক বাবা, মা সন্তানের জিম্মাদার ও হেফাজতকারী হিসাবে ভুমিকা পালন করবে।
চ) মা সন্তানের লালন পালনকারী। মায়ের দায়িত্ব সন্তানদের দেখাশুনা করা। সন্তানেরা মায়ের কাছে থাকবে এবং বাবা সমস্ত খরচ বহন করবে।
ছ) মুসলিম আইনে বাবা তার দায়িত্ব পালন না করলে অভিভাবকত্বের দাবি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পার হবার পরও সন্তানেরা মায়ের কাছে থাকতে পারবে।
মা কখন সন্তানের জিম্মাদার থাকতে পারবে না
১. মা অসৎ জীবন যাপন করলে।
২. মা এমন কাউকে বিয়ে করলে যার সঙ্গে তার নিজের কন্যার বিয়ে হওয়ার ব্যাপারে ধর্মীয় নিষেধ নেই।
৩. সন্তানের প্রতি উদাসীন, দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে।
ভরণপোষণের অধিকার
ব্যাখ্যা-১: ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮৮ ধারায় বলা আছে, স্ত্রীকে মাসিক ৪০০ টাকার সমপরিমাণ ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবেন। অবশ্য ৪০০ টাকার পরিমাণ যে সময়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার সাথে বর্তমান অবস্থার তফাৎ রয়েছে।
ব্যাখ্যা-২: ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্ত্রী ভরণপোষণের দাবি করে পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন।
এটি একটি দেওয়ানী প্রতিকার। যে জায়গায় স্ত্রী বসবাস করছেন সে জায়গায় পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে। উল্লেখ্য যে, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভরণপোষণ, বিবাহ বিচ্ছেদ, দেনমোহর, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি ব্যাপারে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে বলা হয়েছে। তবে এই অধ্যাদেশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮৮ ধারাকে খর্ব করেনি বলে দুই ধরণের আদালতেই মামলা করা যায়।
ব্যাখ্যা-৩: গার্ডিয়ান এন্ড ওয়ার্ডস এ্যাক্ট অনুযায়ী যদি কোন মা আদালতের রায় অনুযায়ী তার সন্তানদের অভিভাবকত্ব পেয়ে যান তাহলে সন্তানেরা ২১ বছর পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকলেও বাবা সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
ব্যাখ্যা-৪: ১৯৪৬ সালের বিবাহিতা হিন্দু নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণ আইনানুযায়ী, নিম্নোক্ত কারণসমূহের উদ্ভব হলে, একজন বিবাহিতা নারী স্বামীর কাছ হতে পৃথকভাবে থেকেও স্বামীর নিকট হতে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী-
১. স্বামী যদি এমনকোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে যা সে স্ত্রীর কাছ থেকে পায় নি।
২. স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে এবং নিষ্ঠুরতা যদি এমন পর্যায়ের হয় যে স্বামীগৃহে তার জীবনাশংকার ভয় থাকে।
৩. স্বামী যদি স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই তাকে পরিত্যাগ করে।
৪. স্বামী যদি স্ত্রীর বর্তমানে পুনরায় বিয়ে করে।
৫. স্বামী যদি ধর্মান্তরিত হয়।
৬. স্বামী যদি ঘরেই কোন উপপত্নী রাখে অথবা উপপত্নীর সাথে বসবাস করে।
৭. অন্যান্য যৌক্তিক কারণ
ব্যাখ্যা-৫: স্ত্রীর ভরণপোষণ আদায় সংক্রান্ত মামলাভরণপোষণের দাবিতে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮৮ ধারা অনুযায়ী স্ত্রী মামলা করতে পারেন। ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভরণপোষণের জন্য স্ত্রী মামলা দায়ের করতে পারেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীকে ভরণপোষণ না দিলে স্ত্রী স্থানীয় চেয়ারম্যানের নিকট ভরণপোষণের জন্য আবেদন করবেন। চেয়ারম্যান সালিশী পরিষদ গঠন করে সার্টিফিকেট ইস্যু করবেন। এরপরও স্বামী ভরণপোষণ না দিলে স্ত্রী বকেয়া ভূমি রাজস্ব আকারে তা আদায় করতে পারবেন।
ব্যাখ্যা-৬: প্রথমতঃ অবহেলিত সন্তানেরা ফৌজদারি দন্ডবিধির ৪৮৮ ধারার অধীনে ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে পিতাকে ভরণপোষণ দানের নির্দেশ দেয়ার জন্য মামলা দায়ের করতে পারে।
এছাড়া পারিবারিক আদালতেও মামলা দায়ের করে ভরণপোষণ আদায়ের ব্যবস্থা আছে। উল্লেখ্য যে, ফৌজদারি আইনের ৪৮৮ নং ধারায় হিন্দু ও খ্রিস্টান স্ত্রী এবং সন্তানেরাও ভরণপোষণ বা খোরপোষের দাবিতে আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন।
তালাক ও খোরপোষ
মুসলিম পারিবারিক আইন অুনযায়ী বিয়ের মাধ্যমে স্থাপিত সম্পর্ককে আইনগত উপায়ে ভেঙ্গে দেয়াকে তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ বলে। আইনের দৃষ্টিতে বিয়ে একটি চুক্তি। এর রয়েছে ধর্মীয় ও সামাজিক ভিত্তি। আইন অনুযায়ী একটি বিয়ের যে কোনো পক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে। যাকে আমরা বিবাহ বিচ্ছেদ বলি। বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী সবারই সমান অধিকার রয়েছে।
আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা হলো, যেকোনো সময় স্বামী চাইলেই তালাক দিতে পারে। দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে থাকে স্বামীর মেজাজ-মর্জির ওপর। স্বামী যে ক’দিন চাইবে সে ক’দিন স্ত্রী ঘর-সংসার করবে। স্বামীর মন চাইলেই আউট। আসলে এই ধারণা আইন ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে বেআইনী।
আইনে যদিও তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর অধিকার বেশি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে স্ত্রীদের তালাক দেয়ার কোনো অধিকার নেই। স্ত্রী বা স্বামীকে কিছু আইনগত শর্ত পালন করতে হয়। এ শর্তগুলো পালন করলেই তালাকের প্রশ্ন আসে। স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়া অধিকার প্রদান করতে পারে। একে আইনের ভাষায় তালাক-ই-তৌফিজ বলা হয়। অর্থাৎ স্ত্রীও তার স্বামীকে তালাক প্রদান করতে পারে।যেসব কারণে স্বামীকে স্ত্রী তালাক দিতে পারে তা ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে কলা আছে। যদি চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকে, বা দুই বছর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হয়, অথবা স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারাদণ্ড হয় তাহলে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে।এছাড় স্বামী কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই নির্দিষ্ট সময় যাবত (তিন বছর) দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে অথবা বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলেও স্ত্রী তালাক দিতে পারে। ওই আইনে স্বামী যদি দুই বছর পাগল থাকে অথবা কোনো গুরুতর ব্যধিতে আক্রান্ত থাকে সেক্ষেত্রেও স্ত্রী তালাক দিতে পারে। স্বামীর ধারাবাহিক নিষ্ঠুরতার কারণেও স্ত্রী তালাক চাইতে পারে।এছাড়া স্বামী বা স্ত্রী যখন দুইজনই তালাকের ব্যাপারে সম্মত হয় তখন একে খুলা তালাক বলে। এছাড়া আদালতের মাধ্যমেও তালাক কার্যকর হতে পারে।
আমাদের দেশে যতো তালাক হয় তার অধিকাংশই অন্যায়ভাবে ও আইন না মেনে সংঘটিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের ওপর দোষ চাপিয়ে তালাক নামক অস্ত্রটি প্রয়োগ করা হয়। যার পুরো সামাজিক, পারিবারিক ও ধমীর্য় দায় বহন করতে হয় একজন নারীকে। স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেয়া একজন স্বামীর আইনগত দায়িত্ব। কিন্তু তালাক হয়ে গেলে স্ত্রীর ভরণপোষণ দেয়া স্বামীর ওপর বর্তায় না। প্রায় সব মুসিলম রাষ্ট্রগুলোতে এটাই প্রচলিত আইন ও রীতি। তালাকের পর নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। কিন্তু সে সময় পার হলে স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেয়া স্বামীর দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। কিন্তু ১৯৮৫ সালে ভারতের একটি মামলার (মো: আহমেদ খান বনাম শাহ বানু বেগম) রায়ে বলা হয়, একদজন নারী পুন:বিবাহ না করা পর্যন্ত ভরণপোষণের অধিকার পাবে। এটি মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একই মতামত আমরা দেখি বাংলাদেশের একটি মামলায় (মো: হেফজুর বহমান বনান সামছুন নাহার বেগম) যেখানে একজন নারী তালাকপ্রাপ্তা হিসেবে যতদিন পরিচিত থাকবেন (অর্থাৎ আবার বিয়ে না করবেন) ততোদিন পর্যন্ত ভরণপোষণ পাবেন। পরবর্তীতে (১৯৯৮ সালে) হাইকোটের এ আদেশটি আপিল বিভাগ খারিজ করে দেয়। পবিত্র কুরআনের সুরা বাক্বারার ২৪১ নং আয়াতের যে ব্যাখ্যা হাইকোট দিয়েছে তা গ্রহণ করেনি আপিল বিভাগ। তবে, অন্য কয়েকটি দেশে অন্যায়ভাবে স্ত্রীকে তালাক দিলে সেক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট বা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ দেয়ার বিধান আছে।
অন্যায় ও বেআইনীভাবে কোনো নারীকে যদি তালাক দেয়া হয় সে ক্ষেত্রে ইদ্দত সময়ের বাইরেও ওই নারী যতদিন পুন:বিবাহ না করেন ততদিন ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। পাকিস্তান, মালয়েশিয়ায় এরকম বিধান আছে। পাকিস্তানের ২০০৯ সালের সংশোধিত পারিবারিক আইন ও মালয়েশিয়ার ১৯৮৪ সালের আইনে এই বিধান যুক্ত করা হয়। এছাড়া ইরাক, মিশর, জর্ডান, তুরস্কেও এ বিধান আছে। তবে সব দেশে যে বিধানটি একই রকম তা নয়। এ জাতীয় ভরণপোষণ দিতে হয় দুই বছর পর্যন্ত আবার কোথাও বাসস্থানের ব্যবস্থাও করে দিতে হয়। আমাদের এখানে বিবাহ ও তালাক সম্পর্কিত আইন হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১। এ আইনের ৭ ধারায় তালাক সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে।
এখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে, তিনি যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্র সম্ভব চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ দিবেন এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের একটি কপি প্রদান করবেন। কোনো ব্যক্তি যদি নোটিশ না দেয় তাহলে তিনি ১ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। কোনো তালাক যদি প্রত্যাহার করা না হয়, তাহলে চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ প্রদানের তারিখের নব্বই দিন পর তা কার্যকর হবে। তবে, তার আগে নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং উক্ত সালিসী পরিষদ এই জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বিষয়টি যদি সমাধানযোগ্য হয়, তবে তার সমাধান করতে হবে। এটিই মূলত চেয়ারম্যান বা কমিটির কাজ। চেয়ারম্যানকে নোটিশ প্রদানের কারণ এটাই। একই আইনের ৯ ধারায় আছে, কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে পর্যাপ্ত ভরণপোষণ বা খোরপোষ দানে ব্যর্থ হলে বা একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে তাদেরকে সমান খোরপোষ না দিলে, স্ত্রী বা স্ত্রীরা চেয়ারম্যানের কাছে দরখাস্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং ঐ পরিষদ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ প্রদানের জন্য টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে সার্টিফিকেট জারী করবেন। স্বামী যদি ভরণপোষণের কোনো টাকা যথাসময়ে বা সময়মত পরিশোধ না করে তাহলে তা বকেয়া ভূমি রাজস্ব হিসাবে তার কাছ থেকে আদায় করা হবে।