'পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা থাকলে সমাজও সাম্প্রদায়িক হবে'
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০১৭, ২৩:৩২
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ৬ মার্চ ২০১৭ বিকাল ৩:০০ মিনিটে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সুফিয়া কামাল ভবনের আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে ‘'অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক, নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজ গঠনের লক্ষে শিক্ষানীতি ও পাঠ্যসূচি চাই' শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্টি জনাব মফিদুল হক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিম আক্তার হোসাইন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জনাব গোলাম কুদ্দুস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌফিকুল হক।
সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়শা খানম বলেন, "পাঠ্যসূচির পরিবর্তন আমাদের উদ্বেগের বিষয়। বর্তমানে এই পরিস্থিতির আগে আমরা ২০১০ থেকে কিছু বিষয় লক্ষ করছিলাম। আমরা যখন নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে অ্যাকশন প্ল্যান করতে গেলাম তখন আমরা দেখলাম এবং সিডও বিষয়ে আমরা দেখলাম কোরান সুন্নার সাথে যেগুলো পরিপন্থী সেগুলো বলা যাবে না। এখন আমরা শুনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কিছু পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হয়। কিন্তু এই নেতিবাচক পদক্ষেপগুলোই আমাদের উদ্বেগের বিষয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে, পাঠ্যসূচিতে এই পরিবর্তন সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রেই যদি সাম্প্রদায়িকতা থাকে তাহলে সেই সাম্প্রদায়িকতা পুরো সমাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী অধিকার রক্ষা এবং পাঠ্যসূচি পরিবর্তনের যে কৌশলগুলো করা হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা রয়েছে। কিন্তু আমরা আশা করি এই বিপর্যয় এই পরিস্থিতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারবো"।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, "আমাদের রাজনীতিতে পারস্পরিক সাফল্য আমরা কতটুকু অর্জন করতে পারি সেটাই দেখার বিষয়। ৩৪ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি ফেডারেশন, কিন্তু কোন প্রতিবাদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেনি, দু একটি ছাত্র সংগঠন ছাড়া কেউই এর প্রতিবাদ করেনি। কেন এই প্রতিবাদ হয়নি সেটা ভেবে দেখা দরকার। যারা প্রতিবাদ করবে তারা প্রতিবাদে ইচ্ছুক নয়"।
তিনি বলেন, "২০১৯ সালের আগে এর পরিবর্তন হবে না। কারণ এটি সরকার করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়। হেফাজতের কৌশল এখানে সফল হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের, জসীমউদ্দিনের, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা বাদ দিয়ে একটি নিয়েছে। আবার কারোটা একবারেই বাদ দিয়েছে"।
তিনি বলেন, "হেফাজতের দাবি মানলে আমাদের দাবি মানতে হবে। এবং দরকার হলে নাগরিক পর্যায়ে একটি শিক্ষা কমিশন থাকতে হবে"।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জনাব মফিদুল হক বলেন, "বাংলাদেশে প্রাথমিক মাধ্যমিক পর্যায়ে আড়াই কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থী নিজেকে গড়ে তোলে। বর্তমানে আমরা যে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছি তা এই পাঠ্যপুস্তক দেখে বোঝা যায়। কারিকুলাম প্রণয়নের একটি প্রক্রিয়া আছে। সামজিক ভিত্তিহীন একটি গোষ্ঠি এই প্রক্রিয়ায় দাবি দিয়েছে এবং তা মানা হচ্ছে। যা গোটা দেশটিকে আবারো একটি ভয়বহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও আমরা আশাবাদী কারণ শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক একটি আলোচনা আমরা তৈরি করতে পেরেছি। আমদের সকলের প্রচষ্টার মাধ্যমে এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি থেকে বরে হয়ে আসতে পারবো বলে আশা করছি"।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, "পাঠ্যসূচির এমন অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন আমাদের আশা ছিল না। আমরা এর প্রত্যাহার চাই। রাষ্ট্রে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে শিক্ষায় গড়ে উঠবে তার জন্য যত টাকা ব্যয় হোক না কেন তা রাষ্ট্রের করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছাই এখানে যথেষ্ট। সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচার, জঙ্গীবাদ শক্ত হাতে মোকাবেলা করছে। সরকারের এই ভূমিকার সাথে পাঠ্যপুস্তকের এই পরিবর্তন সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্রে সকল নাগরিকেরই সম অধিকার। পড়ালেখার পাশাপাশি মানবিক গুণাবলী বৃদ্ধির জন্য এবং কুসংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল মানুষ গড়ার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে"।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, "শুধুমাত্র শব্দ বদল নয় এটা গভীর ষড়যন্ত্র। আমরা পাকিস্তানের সেই ভাবধারাতেই ফিরে যাচ্ছি। হেফাজত এই দেশের মূল স্পিরিটকে ধারণ করে না। একেবারে শিশুকাল থেকেই তারা মগজ ধোলাইয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যে জাতীয়তাবাদের আদর্শ লালন করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা রক্ষার জন্য আমাদের সকলকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে"।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌফিকুল হক বলেন, "পাঠ্যপুস্তকে আমরা যে ধরণের বিষয়গুলো লক্ষ করছি এগুলো একধরণের বিপর্যয়। বর্তমানে যে শক্তি ক্ষমতায় আছে, আমরা নিরাপদ বোধ করি। কিন্তু সেই জায়গাটি অনেকটাই শিথিল হচ্ছে। হেফাজত যে বিষয়গুলোর পরিবর্তন চেয়েছে সে বিষয়গুলোর পরিবর্তন পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন হয়েছে, যা আমাদের জন্য ভাবনার বিষয়। এদেশে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হোক যেখানে আমরা সমমনা মানুষ তৈরি করতে পারবো। যে বিষয়গুলো বাদ পড়েছে সেগুলোকে অনতিবিলম্বে অন্তর্ভূক্ত করা হোক"।
সংগঠনের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, "বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বহুমাত্রিক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি উদ্বেগের বিষয় প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকে আশংকাজনক বেশ কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন আমরা লক্ষ করছি যা দেশবাসীর মধ্যে শংকার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ মনে করে যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য একই তাই আমরা সকলে মিলে একসাথে কাজ করলে এই বিপর্যয় থেকে বের হয়ে আসতে পারবো"।
মতবিনিময় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহ-সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, লক্ষ্মী চক্রবর্তী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ, সীমা মোসলেম, সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড মাসুদা রেহানা বেগম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমদ, অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম, রোকেয়া সদন সম্পাদক নাসরিন মনসুর, সংষ্কৃতি সম্পাদক বুলা ওসমানসহ সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।