সাত খুন মামলা: ২৬ আসামির ফাঁসি
প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:২৪
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৬ আসামির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। বাকি নয়জনকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। একই সময়ে একই স্থানে আরেকটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালককে অপহরণ করা হয়।
ঘটনার তিন দিন পর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকায় শীতলক্ষ্যা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রত্যেকের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন; প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেওয়ার ওই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়। ওই হত্যাকাণ্ডে এলিট বাহিনী র্যাবের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হয়।
লাশ উদ্ধারের পর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন, যার তদন্ত চলে একসঙ্গে। দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে র্যাব সদস্যদের দিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
অন্যদিকে নজরুলদের অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় ঘটনাচক্রে আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ি চালককেও হত্যা করা হয় বলে তার জামাতা বিজয় কুমার পালের ভাষ্য।
আসামিদের মধ্যে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ঘটনার ১৭ মাস পর মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, আসামিদের মধ্যে ২১ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তদন্ত চলাকালে নূর হোসেন ভারতে থাকায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পায়নি পুলিশ।
গ্রেপ্তার র্যাব সদস্যরা আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তাতে হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে আসে। তারা জানান, অপহরণের পর সাতজনকে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করা হয়। পরে মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় শ্বাস রোধ করে। লাশগুলো শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়ার সময় ডুবে যাওয়া নিশ্চিত করতে বেঁধে দেওয়া হয় ইটের বস্তা। আর লাশ যাতে ফুলে না ওঠে সেজন্য চিরে ফেলা হয় লাশে পেট।
জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার আসামিদের বিচার শুরু করেন। ৩৮টি কার্যদিবসে ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শী সহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৬৪ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে গত ৩০ নভেম্বর বিচারক ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দেন।
সোমবার এই চাঞ্চল্যকর মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আদালতে ঢোকার মুখে বসানো হয় আর্চওয়ে; সেখানে সবাইকে তল্লাশি করা হয়। আইনজীবী এবং বাদী ও আসামিপক্ষের স্বজনদের ছাড়া কাউকে আদালতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শফিউদ্দিন জানান, আদালত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাঁচ শতাধিক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। সাইনবোর্ড এলাকা থেকে আদালত চত্বর পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলা হয়।
গ্রেপ্তার ২৩ আসামির মধ্যে ১৮ জন ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে। সকাল ৯টার দিকে তাদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। আর নূর হোসেন, তিন সাবেক র্যাব কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ আসামিকে সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে তিনটি প্রিজন ভ্যানে করে কাশিমপুর কারাগার থেকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে নিয়ে আসা হয়।
সোমবার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে জনাকীর্ণ আদালতে নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ঘড়িতে ১০টা বাজার ঠিক আগে আগে আসামিদের আদালত কক্ষে নিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়। এর পরপরই এজলাসে আসেন বিচারক, আদালত কক্ষে নামে পিন পতন নীরবতা।
সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলা হলেও বিচার চলে একসঙ্গে। বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন একটি মামলা হিসেবে বিবেচনা করেই রায় ঘোষণা করেন। বহু প্রতীক্ষিত এ মামলার রায় ঘোষণা করতে বিচারক সময় নেন মাত্র কয়েক মিনিট। আসামিদের অপরাধের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ অংশ বাদ দিয়ে সাজার অংশটিই কেবল তিনি পড়ে শোনান।
রায়ের সময় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা নূর হোসেন, ওই হত্যাকাণ্ডের সময় র্যাব-১১ এর অধিনায়কের দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বরখাস্ত) মাসুদ রানাসহ ২৩ আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। বাকি ১২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েননি।
রায় ঘোষণার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলামের সমর্থক এবং আইনজীবী চন্দন সরকারের সমর্থকরা আদালতের বাইরে উল্লাসে ফেটে পড়েন।