মোটরগাড়ি চালানোর আইন
প্রকাশ | ০৪ জানুয়ারি ২০১৭, ২৩:৪৩
ঢাকাসহ সারাদেশের নগরগুলোতে মোটরগাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। মোটরগাড়ি চালানোর আইন-কানুন না জানা কিংবা আইন-কানুনকে তোয়াক্কা না করার প্রবণতাই এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও রয়েছে মোটরগাড়ির জন্য প্রযোজ্য বিশেষ আইন। মোটরগাড়ি চালাতে গিয়ে এগুলো অমান্য করলে আপনার বিরুদ্ধে জরিমানা কিংবা মামলা হতে পারে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাকে একটি আইনি কাঠামোতে আনার জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার 'মোটরযান অধ্যাদেশ' প্রণয়ন করে। আইনটিতে ১৭৭টি ধারা রয়েছে; যেখানে গাড়ির লাইসেন্স, নবায়ন, মালিকানা বদল, রুট পারমিটসহ রয়েছে মোটরগাড়িসংক্রান্ত সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। প্রাইভেট কার, মোটরবাইক, বাস, ট্রাক ইত্যাদিসহ মোটরচালিত যে কোনো যানবাহনের চালকের ক্ষেত্রেই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা মাত্রই তার গাড়ি আটক করতে পারে ট্রাফিক পুলিশ।
যেসব কারণে আইন ভঙ্গ হয়
ট্রাফিক সার্জেন্টরা বিভিন্ন কারণে আটক করতে পারেন আপনার গাড়িকে। এসবের মধ্যে আছে গাড়ি চালানোর সময় ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশনা না মানা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, গাড়ির ফিটনেসসংক্রান্ত কাগজপত্র নবায়ন না করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন না করা, নির্ধারিত রুট পারমিটের রাস্তা ব্যবহার না করা, নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করা, ওভারটেক করা, রাতে হেডলাইট না জ্বালিয়ে গাড়ি চালানো, সিটবেল্ট না বাঁধা, মোটরবাইকে দুজনের বেশি যাত্রী বহন করা, হেলমেট না পরা, সঠিক জায়গায় গাড়ি পার্ক না করা, গাড়িতে নাম্বার প্লেট না থাকা, মদপান বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো ইত্যাদি।
যানবাহনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
মোটরসাইকেলের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো হলো রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ইন্সুরেন্স সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স। মাইক্রো বাস/কার বা বাস ভাড়ায় চললে উলি্লখিত কাগজগুলোর বাইরে প্রয়োজন হবে ফিটনেস সার্টিফিকেট ও রুট পারমিট। ভাড়ায় না চললে রুট পারমিটের প্রয়োজন পড়বে না।
আইন ভাঙলে জরিমানা
আইন লঙ্ঘনের দায়ে গাড়ির একটি কিংবা দুটি কাগজ জব্দ করার পর আইন ভঙ্গকারীকে একটি রসিদ দেয়া হয়। ট্রাফিক পুলিশের থাকে বিভিন্ন জোন। পুলিশের দেয়া রসিদে লেখা থাকে কোন জোনের ট্রাফিক পুলিশ আটক করেছে আপনার গাড়িটি। রসিদে জোনভিত্তিক উপস্থিতির সময়ও লেখা থাকবে। সেই সময় অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জোনের অফিসে গিয়ে আপনাকে যোগাযোগ করে দিতে হবে জরিমানার টাকা। এ ছাড়া কোথায়, কী অপরাধে আপনাকে জরিমানা করা হয়েছে, কে জরিমানা করলেন, কত তারিখে জরিমানা করা হয়েছে, কত তারিখের মধ্যে আপনাকে হাজিরা দিতে হবে সবকিছুই রসিদে উল্লেখ করা থাকে। তবে জেলা শহর ও বিভাগগুলোয় ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য নির্ধারিত জরিমানার টাকার পরিমাণও বিভিন্ন ধরনের হয়।
বিভিন্ন অপরাধে জরিমানার পরিমাণ
১৩৭ ধারা অনুসারে যে কোনো অপরাধের শাস্তি প্রদানে ২০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। ১৩৯ ধারা অনুসারে নিষিদ্ধ হর্ন কিংবা শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র লাগালে ১০০ টাকা, ১৪০ ধারা অনুসারে আদেশ অমান্য, বাধা সৃষ্টি ও তথ্য প্রদানে অস্বীকার করলে ৫০০ টাকা, ১৪২ ধারা অনুসারে নির্ধারিত গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালালে ৩০০ টাকা, ১৪৬ ধারা অনুসারে দুর্ঘটনাসংক্রান্ত অপরাধে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ১৪৯ ধারায় নিরাপত্তাহীন অবস্থায় গাড়ি ব্যবহার করলে ৩০০ টাকা, ১৫০ ধারা অনুসারে ধোঁয়া বের হলে ২০০ টাকা, ১৫১ ধারা অনুসারে আইনের সঙ্গে সঙ্গতিহীন অবস্থায় গাড়ি বিক্রি বা গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন করলে যথাক্রমে ৫০০০ ও ১২৫০ টাকা, ১৫২ ধারা অনুসারে রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস সার্টিফিকেট অথবা পারমিট ছাড়া মোটরগাড়ি ব্যবহার করলে ৭০০ টাকা, ১৫৪ ধারা অনুসারে অনুমোদিত ওজন অতিক্রম করে গাড়ি চালালে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ১৫৫ ধারা অনুসারে বীমা ছাড়া বা মেয়াদ উত্তীর্ণের জন্য ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা, ১৫৬ ধারা অনুসারে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ১৫৭ ধারা অনুসারে প্রকাশ্য সড়কে অথবা প্রকাশ্য স্থানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
জরিমানা হলে করণীয়
জরিমানার রসিদ হাতে পাওয়ার দু-তিন দিনের মধ্যেই নির্ধারিত ট্রাফিক পুলিশ অফিসে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেয়া উচিত। জরিমানার টাকা কোথায় কিভাবে জমা দিতে হবে, সে সম্পর্কিত তথ্য জানা যাবে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে। ট্রাফিক পুলিশের নির্দিষ্ট কাউন্টার, কোনো ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো অনুমোদিত জায়গায় জরিমানার অর্থ জমা দেয়ার ব্যবস্থা থাকে।
জরিমানা পরিশোধ না করলে
জরিমানা পরিশোধ না করলে ঝামেলা আরো বেড়ে যাবে। তখন অপরাধের ধরন, ঘটনাস্থল ইত্যাদি প্রতিবেদনসহকারে মামলাটি আদালতে পাঠানো হবে ওয়ারেন্ট ইস্যু করার জন্য। আদালত থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যুর পর পুলিশ কর্মকর্তারা রাস্তায় সংশ্লিষ্ট গাড়িটি আটক করেন এবং ওয়ারেন্ট ইস্যুর পর গাড়িটি ছেড়ে দেন। ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তির কাজটিও কঠিন নয়। ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তির পর জন্য ওয়ারেন্ট নাম্বারটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোর্টে হাজির হয়ে জিআর শাখার মাধ্যমে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়।
জরিমানার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন
জরিমানা নির্ধারণের পর আপনি যদি মনে করেন আপনার ওপর পুলিশের তরফ থেকে অন্যায় করা হয়েছে এবং অন্যায়ভাবে আপনাকে জরিমানা করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আপনি আদালতেও যেতে পারেন এবং পুলিশের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। সামান্য জরিমানার জন্য আদালতে গিয়ে আর্থিক বিচারে তেমন কোনো লাভ হয় না, তবে রায় যদি আপনার অনুকূলে যায়, সে ক্ষেত্রে তা আপনার জন্য একটি নৈতিক বিজয় হবে। সাধারণত এত ঝামেলা করে কেউ জরিমানা চ্যালেঞ্জ করতে আদালতে যায় না।
জেনে রাখুন কিছু উল্লেখযোগ্য ট্রাফিক আইন
ট্রাফিক আইনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আইন দেখে নেয়া যাক- ১. আঠারো বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহার্য স্থানে মোটরযান চালাতে পারবেন না। ২. এক ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স অন্য ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারবে না। ৩. বাস, ট্রাক বা অন্য গণপরিবহন কিংবা পণ্যবাহী যানে কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করতে হলে অবশ্যই লাইসেন্স থাকতে হবে। ৪. আঠারো বছরের কম বয়সী কেউ কন্ডাক্টরের কাজ করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। ৫. সর্বসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো মোটরযান চালানো যাবে না। ৬. ত্রুটিমুক্ত সনদ সংগ্রহের পর মোটরযান নিবন্ধনের জন্য বিবেচিত হবে। ৭. মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি আরোহী হওয়া যাবে না। ৮. মোটরসাইকেল চালক এবং তার সঙ্গীকে অবশ্যই হেলমেট পরতে হবে। ৯. গাড়ির বাম্পার কিংবা ছাদে আরোহণ করা যাবে না। ১০. কোনো গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা যাবে না।