এখনো সনদ পাননি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হাজেরা সুলতানা
প্রকাশ | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ০২:৫৭
নানা কারনেই মহান মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে টাঙ্গাইল। আর সেই মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের নারী সংগঠকের মধ্যে অন্যতম হাজেরা সুলতানা। জীবনবাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করলেও স্বাধীনতার ৪৫ বছরে তার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বা সনদ না হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন তার সহযোদ্ধাগণ।
বর্তমানে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি হাজেরা সুলতানা ১৯৫০ সালে কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ী ইউনিয়নের ছাতিহাটী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আহম্মেদ আলী সরকার এবং মাতার নাম জমিরন নেসা। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং স্বাধীনচেতা।
১৯৬৬ সালে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৬৮ সালে কুমুদিনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর সরকারি সা’দত কলেজে ভর্তি হন হাজেরা সুলতানা। ছাত্রজীবনেই ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং নিজেকে একজন নারী নেত্রী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৭০ সালে হাজেরা সুলতানা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালে প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে হাজেরা সুলতানা শুধু অস্ত্র হাতে তুলে নেননি, একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় কাজ করেছেন।
৭১’র মার্চে টাঙ্গাইলে পিটিআই মাঠে পাকিস্তানী পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে পোড়ানোর কারনে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এরপর কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের উদ্যোগে টাঙ্গাইলের যমুনাচর এলাকায় কমান্ডার আব্দুল হালিমের (ইকবাল) নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে।
হাজেরা সুলতানা এখান থেকেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন এবং বাহিনীর একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে অক্লান্ত ভাবে কাজ শুরু করেন।
এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের সাথে বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে মিলিত হয় এবং তাদের দলের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ডাকাত দল চর এলাকার সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অমানবিক অত্যাচার এবং টাকা-পয়সা লুট করতে শুরু করে। হাজেরা সুলতানার নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনের ফলে ডাকাতরা প্রতিহত হয়।
পরবর্তীতে গেরিলাযুদ্ধের কিংবদন্তি আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর আহ্বানে কমিউনিস্ট বাহিনীটি কাদেরীয়া বাহিনীর সাথে একিভূত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
হাজেরা সুলতানা সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি এবং মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল খান মাহবুব বলেন, "তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হননি। ৬৯ এর গণআন্দোলনে যেমন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পথ সৃষ্টির সকল সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭১-এ হাজেরা সুলতানা যখন বোরকা পড়ে আমাদের কাছে জীবন ঝুঁকি নিয়ে টাঙ্গাইলের খবরাখবর এনে দিতেন তখন তার সাহসী ভূমিকা দেখে আমরা ভিষণভাবে অনুপ্রাণিত হতাম"।
এছাড়া তিনি এসিড বাল্ব, হাতবোমা তৈরি এবং অসুস্থ্ যোদ্ধাদের সেবা সুশ্রুষা করতেন বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, "হাজেরা সুলতানার মতো একজন সশস্ত্র নারী যোদ্ধা এখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হয়নি এই বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো নয় এবং অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ অমুক্তিযোদ্ধাদেরও সনদ-সুবিধা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে"।
শুধু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নয় মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্যে তাকে বিশেষ সম্মাননা দেয়ার জন্যে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
কাদেরীয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান সাবেক সচিব আনোয়ার উল আলম শহীদ বলেন, "মুক্তিযুদ্ধে আমি হাজেরা সুলতানাকে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে দেখেছি। নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ভূমিকা প্রশংসনীয়"।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সন্তোষের কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী হাজেরা সুলতানা বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য এবং নারীমুক্তি সংসদের সভানেত্রী।
এছাড়া বিভিন্ন সময় তিনি জঙ্গিবাদ বিরোধী এবং শ্রমিক অধিকার আন্দোলনে সারাদেশে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে হাজেরা সুলতানা হায়দার আকবর খান রনোকে বিয়ে করেন এবং তার একমাত্র কন্যা সন্তান রানা সুলতানা।
হাজেরা সুলতানা ১৯৯১ সালে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী হিসেবে কালিহাতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
২০১৪ সালের দশম সংসদে এই দলের সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনিত হয়ে দায়িত্বপালন করছেন। তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত নতুন কথা নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনাও করছেন।
এ বিষয়ে হাজেরা সুলতান বলেন, "দেশের জন্য কাজ করেছি এবং করছি। কোন চাওয়া-পাওয়া থেকে নয়। নিজের চেতনা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারিভাবে তালিকায় কিংবা গেজেটে নাম থাকা প্রয়োজন। এর আগে জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনামলে তালিকাভুক্তির আবেদন করেছিলাম কিন্তু হতে পারি নাই। এবার আবার আবেদন করেছি। আশা করছি যাচাই বাছাই শেষে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি ও সরকারি তালিকায় স্থান পাবো"।