জীবন যেখানে লাশের মতোই স্থবির
প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৪৯ | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৩৯
জমি থেকে উচ্ছেদ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ আর পুলিশের গুলিতে ৩ জন সাঁওতাল এর মৃত্যুর পর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের জীবন এখন লাশের মতোই স্থবির হয়ে গেছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় তারা জানেন না এখন কি করবেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, পারিবারিক সহায়সম্বল পুড়ে গেছে অনেক সাঁওতাল পরিবারের। ভিটেমাটি তো গেছেই, এখন খাওয়ার খাদ্য পর্যন্ত নেই। হুমকির কারণে বয়স্করা বাজারে বা কর্মস্থলে পর্যন্ত যেতে পারছেন না। খাবার জুটবে কিনা আদৌ তার কোন নিশ্চয়তাই নেই।
সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, "সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন সাইকেল, টাকা-পয়সা নিয়ে রাস্তায় বের হলেই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাদের হাটবাজার করতে দিচ্ছে না"।
একই গ্রামের সাঁওতাল গৃহিণী ছানি বাস্কে (৩৫) বলেন, “ফার্মের জমিতে তোলা আমাদের ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কাপড়, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও চাল-ডাল পুড়ে গেছে। এখন খাবার নেই। আইজ (শুক্রবার) সকালে লবণ-চা খেয়েছি। দুপুর-রাতে কী খাব বুদ্ধি নাই।”
সাহেবগঞ্জের পাশের এলাকার বাসিন্দারা সাঁওতাল পরিবারের লোকজনদের যেখানে পাচ্ছে সেখানেই মারধর করছে বলে অভিযোগ সাঁওতালদের।
জোবা টুডু বলেন, “ঘটনার পর থেকে আমরা বন্দি। গ্রাম থেকে বাইরে যেতে পারছি না। এখন বড় অসহায়। আমাদের পাশে কেউ এসে দাঁড়াতেও চাইছে না।”
জয়পুর পাড়ার মেরি টুডু (৫৫) বলেন, “স্বামীর অসুস্থতার কারণে আমাকে সংসারের কাজ করতে হয়। কিন্তু আমরা ভয়ে কোথাও যেতে পারছি না। খাওয়ার চাল ফুরিয়ে গেছে।”
মাদারপুর গ্রামের মুগলু টুডু বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর তাদের সম্প্রদায়ের লোকজন এই এলাকা ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেছেন। কিন্তু তারপরও স্থানীয় কিছু লোক বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে গরু-ছাগল লুটপাটসহ ভয়ভীতি দেখিয়ে গেছে। তাই ওই গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ ও হাট বাজারে যেতে পারছে না।
ছেলেমেয়েদের সামনে রয়েছে প্রাথমিক সমাপনী ও বার্ষিক পরীক্ষা। কিন্তু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেকের বইপত্র পুড়ে গেছে। আবার হুমকির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন না কেউ কেউ। সামনে পরীক্ষা দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় সবাই।
মাদারপুর গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রভাতী কিসকু, চতুর্থ শ্রেণির স্মৃতি মুরমু ও সীমান্ত মুরমু, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের মেরিনা সরেনসহ শতাধিক শিক্ষার্থীর একই অবস্থা। নিরাপত্তাহীনতার কারণে স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধের কথা বলছে তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণী বলেন, বাড়ি থেকেই তিনি নিয়মিত কলেজের যাতায়াত করতেন। সম্প্রতি স্থানীয় কিছু লোক বিভিন্ন ধরনের ভয়-ভীতি দেখানোর ফলে কলেজে যেতে পারছেন না।
একই গ্রামের মুখি মুরমু (৪৫) বলেন, তার ছেলে রিপন মুরমু ক্লাস নাইনে পড়ে। ওর বই-খাতা পুড়ে গেছে। তাই স্কুল যাওয়াও বন্ধ হয়েছে।
ফেরেজা বাস্কে (৪০) বলেন, তার সন্তান সীমান্ত মুরমুর বই-খাতা, স্কুলব্যাগ, কাপড়সহ অন্য জিনিসপত্র পুড়ে গেছে। দুটি গরু, হাঁড়িপাতিল লুট হয়েছে।
সাহেবগঞ্জ ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল বাকি বলেন, সাঁওতাল পরিবারের প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী এই স্কুলে পড়ছে। তারা এখন বিদ্যালয়ে আসছে না। এ নিয়ে একাধিক পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন গত রবিবারের উচ্ছেদ ঘটনার পর থেকে ভয় ও অজানা এক আতঙ্কে তারা স্কুলে আসছে না।
উল্লেখ্য, গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির দখলকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন সাঁওতালের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
ওই এলাকার (গাইবান্ধা-৪) আওয়ামী লীগের সাংসদ আবুল কালাম আজাদ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আলম বুলবুলের নেতৃত্বে সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।