কূটনীতিতে বিশ্বের সেরা হতে চলেছে বাংলাদেশ
প্রকাশ | ২০ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:২৬
আগামী মাসের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নিয়ে কয়েক মাস আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দিন দিন সময় যত গড়াছে ততই যেন বিশ্বের আনাচকানাচে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে।
কিংবা ধরুন, নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণার কথা। চলতি বছরের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে এই সপ্তাহেই। পাকিস্তানের দুই তারকা ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদি ও জাভেদ মিয়াঁদাদের দীর্ঘদিনের ঝগড়ার ইতি ঘটলো এই সপ্তাহে। মুখোমুখি বসে দুজনে মিষ্টিমুখ করেছেন। ইয়েমেনে মার্কিন রণতরিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। ইরাকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শক্ত ঘাঁটি মসুল পুনরুদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে সামরিক বাহিনী। কুয়েতের মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন, ভেঙে দেওয়া হয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট।
এই তো কদিন আগেই শুধু পাকিস্তানে ভেন্যু হওয়ার কারণেই ভেস্তে গেল এবারের সার্ক সম্মেলন। তার আলোচনা চলছে চলতি সপ্তাহেও। অথচ ঠিকই ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বিমসটেকভুক্ত সব দেশের সরকার প্রধানদের নিয়ে ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত হলো অষ্টম ব্রিকস সম্মেলন। এই সম্মেলনেই পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে চেয়েছিলেন মোদি। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এই চীনের সরকার প্রধান আবার ব্রিকসে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভারতে গিয়ে।
চলতি সপ্তাহে এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে চলতি সপ্তাহে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বিশ্বে সেরা বাংলাদেশ। আর একে বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি অংশও বলা যায়।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে বেশি। বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচনা হয়েছে, বাংলাদেশে এসেছেন বিপুল সংখ্যক ফরেন ডেলিগেটস। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- সরকার প্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থাপ্রধান কিংবা মন্ত্রী পর্যায়ের কর্মকর্তা মিলে বাংলাদেশে চলতি সপ্তাহে যে সংখ্যক হেভিওয়েট ফরেন ডেলিগেটস এসেছেন, তা স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
১৫ ও ১৬ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দুদিনের নবম দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সামিট। লা মেরিডিয়ান হোটেলে অনুষ্ঠিত এ সামিটে আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ১০০ জন অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞ অংশ নেন। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে অংশ নেওয়াদের সংখ্যা ছিল দুইশ এর বেশি।
শনিবার (১৫ অক্টোবর) বার্লিন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারপারসন হোসে কার্লোস উগাস সানচেস-মরেনো দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। ২০১৪ সালে টিআই পরিচালনা পর্ষদের প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর একশটিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের সর্ববৃহৎ চ্যাপ্টার হিসেবে টিআইবির আমন্ত্রণে এটাই তার প্রথম বাংলাদেশ সফর।
তার এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন ত্বরান্বিত করতে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ের পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করা।
আগের দিন শুক্রবার ( সকালে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বর্তমান ধাবমান বিশ্বে দ্রুত গতিতে ঈর্ষণীয় উন্নতির পথে চলছে চীন। অনুন্নয়ন আর ধর্মান্ধতার পঙ্কিলতার পথকে তারা অগ্রাহ্য করছে নানা অনুষঙ্গে। তাদের এই উন্নত পথচলায় বাংলাদেশকে তারা বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে। ২০১৭ সালকে ঘোষণা করা হয়েছে দুদেশের ‘বন্ধুত্বের বর্ষ’ হিসেবে।
এই শি জিনপিং চীনবাসীকে বর্তমানে রেনেসাঁর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আর এই রেনেসাঁর দৌড়ে বাংলাদেশকেও পাশে রাখতে চেয়েছেন তিনি। তার এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন। জিনপিংয়ের সফরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, চীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন খাতে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে।
শি জিনপিংয়ের এই সফরকে কেন্দ্র করে বিশ্বে বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসে। বিশেষ করে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার বিষয়টি অনেক দেশই সহজভাবে নেয়নি।
প্রায় ২২ ঘণ্টার সফল সফর শেষে শনিবার(১৫ অক্টোবর) সকালে ঢাকা ছাড়েন শি জিনপিং। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর পরই প্রধানমন্ত্রী ভারতে যান ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে বিশ্বের প্রভাবশালী সরকারপ্রধানদের নিয়ে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
রবিবার(১৬ অক্টোবর) বিকেলে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছান বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য ও দারিদ্র বিমোচনের কৌশল সরেজমিনে দেখতেই বাংলাদেশে আসেন তিনি। বাংলাদেশে এটি তার প্রথম সফর। এমনকি বিশ্বব্যাংক গ্রুপ গঠনের পর প্রথম কোনো গ্রুপ প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এলেন।
তিনি বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ২০০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ খাতে কোনো দেশকে এই প্রথম এত অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শিশুপুষ্টি খাতে আগামী দুই বছরে বাংলাদেশকে বর্তমানের চেয়ে ১০০ কোটি ডলার বেশি সহায়তা দেবে সংস্থাটি।
বুধবার(১৯ অক্টোবর)বাংলাদেশে শুরু হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বড় প্রযুক্তি উৎসব ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড। এতে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছেন আট দেশের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীরা। তারা ‘মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে’ অংশ নেবেন।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে আমরা বৃহৎশক্তিগুলোর বৈরিতার মুখে রয়েছি বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু চলতি সপ্তাহের অভিজ্ঞতায় সেই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হচ্ছে বিশ্বের সমালোচকদেরও। এটি মেনে নিতেই হবে- বহুপক্ষীয় কূটনীতির অঙ্গন ছাড়িয়ে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতা ও কাঠামো ব্যবহারে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করে চলছে, তা ইতিহাসে বিরল। বিশ্বের সকল প্রান্তে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে সুদৃঢ় সম্পর্ক। যার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে বিশ্বের উদীয়মান শক্তিগুলোর সঙ্গে উষ্ণতর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা।
এখানে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি কয়েকটি ধারাবাহিক অর্জন ও সাফল্য উল্লেখ করা হলো। বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের এমন আস্থা ও স্বীকৃতি অনন্য সাধারণ ঘটনা। বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশের দশম সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাহী কমিটির প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। সিপিএ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়ে ড. শিরীন শারমিন বাংলাদেশের হাতের মুঠোয় আরেকটি স্বপ্ন আনেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভের পর এ রকম গৌরব কখনো অর্জিত হয়নি।
সিপিএ গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম। সিপিএর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১২৫ বছরের পুরোনো বিশ্ব সংস্থা ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্য সাবেক হোসেন চৌধুরী। বিশ্বব্যাপী সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা ও সংলাপের প্রাণকেন্দ্র আইপিইউতে বাংলাদেশের বিজয় ছিল অসাধারণ। প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে বাংলাদেশ এই কৃতিত্ব অর্জন করে।
বিশ্বের সর্বোচ্চ দুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে শীর্ষপদে জয়ী হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট শক্তিশালী মানবাধিকার কাউন্সিলে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে এশীয় অঞ্চল থেকে ২০১৫-১৭ মেয়াদে সদস্য নির্বাচিত হয়। বিশ্ব পরিমণ্ডলে অসাধারণ অর্জন ও সাফল্য বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ইতিহাস সূচনরা করে। বিশ্ব কূটনীতির ইতিহাসে সম্ভবত দ্বিতীয় কোনো রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে রাষ্ট্রটি পরপর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব ফোরামে নেতৃত্ব দেওয়ার গৌরব অর্জন করে। বিশেষ করে একই সঙ্গে সিপিএ ও আইপিইউর শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হওয়া একটি অভূতপূর্ব অর্জন। উল্লেখ্য, এ অর্জনসমূহ এসেছে প্রতিটি সংস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে যেখানে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র ভোট দিয়েছে।
চলতি সপ্তাহেও তেমনি দেশি-বিদেশি সকল সমালোচক কিংবা বৈরীপক্ষকে অবাক করে দিয়ে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় পর্যায়ে আমাদের অভূতপূর্ব কূটনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এক নতুন ইতিহাস গড়ে।
এরই মধ্যে বিশ্বের উদীয়মান শক্তিগুলোর সঙ্গে উষ্ণতর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন প্রয়োজন সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। তাহলে অন্যান্য সূচকেও উন্নতির মাধ্যমে রূপকল্প ২০২১ অর্জন, ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে মধ্য আয়ের দেশ কিংবা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র কিংবা ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়া-সবই এখন সময়ের ব্যাপার।