পারভিনের রঙিন স্বপ্ন থেকে গেছে কাঁটাতারের ওপারেই
প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:৫৬ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:০০
মুঠোফোনে পরিচয়। তারপর প্রেম, প্রেম থেকে পরিণয়। পারভিন ভারতের নাগরিক হলেও আস্থা রেখেছিলেন বাংলাদেশী যুবক রাজুর ওপর। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তার হাত ধরেই কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে।
কিন্তু সুখের ঘর বাঁধা হয়নি পারভিনের। এখন শ্বশুর বাড়ির নির্যাতনে তার এ দেশে টেকাই মুশকিল। ধূসর হয়ে গেছে পারভিনের রঙিন স্বপ্নগুলো। তার সব স্বপ্ন যেন থেকে গেছে কাঁটাতারের ওপারেই। কাঁটাতার পেরিয়ে নিজ দেশে ফিরতে পারলেই যেন মুক্তি পান তিনি। অবশ্য এ চেষ্টাও তিনি করেছেন।
পারভিন খাতুনের (২০) বাবার বাড়ি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার রানীতলা থানার ভাণ্ডারা গ্রামে। বাবার নাম নূর ইসলাম। আর শ্বশুরবাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিদিরপুর নামোপাড়া গ্রামে। স্বামীর নাম রাজু আহমেদ (২৫)।
শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সইতে না পেরে গত ৯ অক্টোবর পারভিন এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। ওই দিন তিনি গোদাগাড়ীর সীমান্ত এলাকা চর আষাড়িয়াদহের একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। স্থানীয় এক দালালকে ধরে তিনি কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে যেতে চান। কিন্তু দালালকে দুই হাজার টাকা দিতে না পারায় তিনি সীমান্ত পার হতে পারেননি।
পরে খবর পেয়ে শনিবার সকালে মাটিকাটা ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য ইসমত আর নার্গিস লোক পাঠিয়ে পারভিনকে সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে এনে নিজের বাড়িতে রাখেন। শনিবার সকালে তার বাড়িতেই কথা হয় ওই গৃহবধূর সঙ্গে।
পারভিন খাতুন জানান, তার স্বামী রাজু আহমেদ পেশায় একজন নির্মাণ শ্রমিক। বছর দুয়েক আগে তিনি ভারতের চেন্নাইতে কাজ করতেন। ওই সময় মুঠোফোনে রাজুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজু ওই সময় তাকে জানিয়েছিলেন, তার বাড়ি ভারতেরই কুঠিরামপুর নামক এক স্থানে। দেড় বছর আগে ঠিকানা নিয়ে হঠাৎ একদিন রাজু তার বাড়িতে হাজির। ওই দিনই বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর পারভিন গর্ভধারণ করলে তিনি শ্বশুর বাড়ি যেতে চান। এতে বেকায়দায় পড়ে রাজু তাকে জানান তার আসল ঠিকানা। তবে বিষয়টি তিনি সবার কাছে গোপন রাখতে অনুরোধ করেন। পারভিনও স্বামীর অনুরোধে তার আসল পরিচয় সবার কাছে গোপন রাখেন।
এরপর একদিন পরিবারের কাউকেই কিছু না জানিয়ে স্বামীর হাত ধরে এপারে আসেন পারভিন। এপারে এসে ফোন করে পারভিন তার বাবাকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলেন। এদিকে সুখের আশায় তিনি এ দেশে আসলেও কয়েকদিনের মধ্যেই বদলে যেতে থাকে সবকিছু। এভাবে বিয়ে করে আনায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ওপর শুরু করেন নানা রকম অত্যাচার। স্বামীর আচরণও বদলে যায় দিনে দিনে।
পারভিন জানিয়েছেন, এরই মধ্যে তিনি একবার প্রেমতলী পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করতে যান। কিন্তু নিজের কোনো অভিভাবক নেই দেখে পুলিশ তার অভিযোগ আমলে নেয়নি। স্থানীয় গ্রাম্য মাতবরদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হচ্ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি নিজের দেশের পথে পা বাড়ান। কিন্তু টাকার অভাবে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
জানতে চাইলে অভিযোগ না নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন প্রেমতলী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) পার্থ প্রতীম। তিনি বলেন, "এ রকম কোনো নারীর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। দেখা হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম"।
এদিকে রাজুর প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, যৌতুকের জন্য শ্বশুর মোজাহার আলী, শাশুড়ি রাজেনা বেগম ও ননদ রাকিবা খাতুন কথায় কথায় মারধর করেন পারভিন খাতুনকে। কখনও কখনও বাড়ির দরজা বন্ধ করে তাকে মারপিট করা হয়। এতে পারভিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু তাকে দেয়া হয় না কোনো ধরনের চিকিৎসা সেবা।
প্রতিবেশীরা আরও জানান, পারভিন অন্তঃসত্তা অবস্থায় ভারত থেকে আসেন। মাস ছয়েক আগে পারভিনের সন্তান প্রসবের সময় হয়ে আসলেও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এতে বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, মোজাহার আলী এখন যৌতুক নিয়ে ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চান। রাজশাহীর কাটাখালি এলাকায় মেয়েও দেখাশোনা চলছে। পারভিন ভারতে চলে গেলেই ৬০ হাজার টাকা যৌতুক নিয়ে সেখানে বিয়ে দেয়া হবে রাজুর।
রাজুর প্রতিবেশী আসাদুল হক (৪৮) বলেন, "মেয়েটির কষ্ট দেখে খারাপ লাগে। এ দেশে তার শ্বশুর বাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। তারপরেও শ্বশুরবাড়ির লোকজন যৌতুকের জন্য তার ওপর নির্যাতন করেন। দেখে খুব কষ্ট লাগে"।
সংরক্ষিত আসনের স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য ইসমত আরা নার্গিস সকালে বলেন, পারভিনের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেই। বিয়ে করে এ দেশে এসে বিপদে পড়েছেন। শ্বশুর বাড়ির নির্যাতন সইতে না পেরে ভারতেই চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পারভিন। সীমান্তের গ্রাম থেকে তিনিই লোক পাঠিয়ে তাকে ফিরিয়ে এনেছেন। তার সংসারটা যেন টেকে, তিনি এমন ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারভিনের শ্বশুর বাড়ির লোকজন কারও কথায় শোনেন না।
এ ব্যাপারে কথা বলতে শনিবার সকালে রাজু আহমেদের বাড়িতে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পারভিনের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবি সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক দিল সেতারা চুনি বলেন, "বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। পারভিনের মতো অসহায় নারীদের দেখে রাখার দায়িত্ব এই সমাজের। তার ব্যাপারে সবার খোঁজখবর রাখা দরকার। আমরাও তার ব্যাপারে খোঁজখবর নেব"।