দ্য হিন্দু’কে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার
‘বাংলাদেশ সন্ত্রাস ফেরি করা দেশ নয়’
প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০১৬, ০০:১৮
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ এশিয়ার চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
সম্প্রতি ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন দ্য হিন্দু’র কূটনীতিবিষয়ক সম্পাদক সুহাসিনি হায়দার। এটি প্রকাশিত হয় শুক্রবার। দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো।
দ্য হিন্দু: ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের উদ্যোগেই সার্ক গঠিত হয়। কিন্তু এবার পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলন বর্জনকারী প্রথম দেশগুলোর একটি ছিল বাংলাদেশ। এর মানে কি সার্কের বিলুপ্তি হচ্ছে?
শেখ হাসিনা: সার্ক বিলুপ্ত হবে না। আমাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেই বলা হয়েছে যে, এ অঞ্চলে বর্তমান যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত সময় নয় বলে আমরা বিবেচনা করেছি।
বাংলাদেশ যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে সংবেদনশীল, সেখানে পাকিস্তান আমাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তুষ্টি জানিয়েছে এবং এমনকি বিষয়টি তাদের পার্লামেন্টেও তুলেছে। তারা অগ্রহণযোগ্য মন্তব্যের মাধ্যমে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। তাদের এ আচরণে আমরা মর্মাহত হয়েছি। এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমরা নিজেদের দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি। এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ থাকার কথা নয়। পাকিস্তানের আচরণের কারণে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার জন্য আমার ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে। কিন্তু আমি বলেছি, সম্পর্ক বহাল থাকবে এবং আমরা নিজেদের বিরোধ মীমাংসা করে নেব। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়েছি এবং তারা পরাজিত শক্তি- এটাই আসল বাস্তবতা। আমরা যুদ্ধে জয়ী পাকিস্তানের কাছ থেকে দেশকে স্বাধীন করেছি। কাজেই এটি অনুমিত যে যুদ্ধাপরাধের বিচার তারা ভালোভাবে নেবে না।
দ্য হিন্দু: পাকিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাস কি আপনার কাছে প্রধান ইস্যু নয়? উরি হামলার পর একই সময়ে বাংলাদেশ, ভুটান, আফগানিস্তান ও ভারত সার্ক সম্মেলন থেকে বেরিয়ে গেছে। পাকিস্তানকে এক ঘরে করার জন্য সমন্বিতভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
শেখ হাসিনা: শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পরিস্থিতির কারণে আমরা সার্ক সম্মেলন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেখানকার সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় শিকার। পাকিস্তানের সর্বত্র সন্ত্রাস বিরাজ করায় আমরা অনেকেই পাকিস্তানের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছি। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা রয়েছে। তবে আমি এসব নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। ভারত সার্ক সম্মেলন বর্জন করেছে উরির হামলার কারণে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্জনের কারণ সম্পূর্ণ আলাদা।
দ্য হিন্দু: সন্ত্রাসীদের হত্যা করতে নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অভিযান চালানোর বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্তকে কি আপনি সমর্থন করেন?
শেখ হাসিনা: আচ্ছা। আমি মনে করি, উভয় দেশেরই সীমান্তরেখার বিষয়টি মেনে চলা উচিত। তাহলে উভয় দেশের মধ্যে শান্তি বিরাজ করবে।
দ্য হিন্দু: আপনি কি এ নীতি (সিদ্ধান্ত) সমর্থন করেন? গত বছরও সীমানা পেরিয়ে মিয়ানমারে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশেও একই ধরনের অভিযান চালালে তা কি আপনি সমর্থন করবেন?
শেখ হাসিনা: আমি মনে করি, আপনার উচিত এসব প্রশ্ন আপনার দেশের সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে করা। আর এখানকার সব দেশের সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই মেনে চলতে হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
দ্য হিন্দু: আমি জানতে চাচ্ছি, কারণ ২০০৯ সালে আপনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল সন্ত্রাসবাদ বিরোধী দমনাভিযান। আপনার সরকার সন্ত্রাসী ঘাঁটি বন্ধ করার পাশাপাশি ২০ জনেরও বেশি মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীকে তুলে দিয়েছিল। এখন সেই সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার আজ কী অর্থ বহন করে?
শেখ হাসিনা: বাংলাদেশে সন্ত্রাসের শেকড় গাড়তে দেয়া হবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। ভারত কিংবা মিয়ানমার, যে দেশের সীমান্তেই হোক না কেন ২০০৮ সাল থেকে আমরা সেখানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নিয়েছি তার সুফল আপনি দেখছেন। আমাদের সীমান্তজুড়ে প্রতিদিনই সহিংসতা, বোমা বিস্ফোরণ, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা চলতো এবং যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি। অন্য দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে আমরা কোনো গোষ্ঠীকেই আমাদের ভূমি ব্যবহার করতে দেব না। অন্য দেশে জঙ্গি হামলা চালাতে কোনো গোষ্ঠীকে আমরা আমাদের দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেব না। বাংলাদেশ এখন আর সন্ত্রাস ফেরি করা দেশ নয় এবং আগের মতো অস্ত্র পাচারের সিল্ক রুটও নয়।
দ্য হিন্দু: এ বছর হলি আর্টিজান বেকারিতে পরিচালিত সন্ত্রাসী হামলা আপনার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে বদলে দিয়েছে?
শেখ হাসিনা: সন্ত্রাসবাদ বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর মোকাবেলায় আমি কিছু ভিন্নতর পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের মাধ্যমে সন্ত্রাসেরবিরোধী সচেতনা সৃষ্টি করছি। এরপর আমি অভিভাবকদের বলেছি সন্তানরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে তার ওপর যেন চোখ রাখে। আমরা মসজিদ-মাদ্রাসার আলেম-উলেমাদের বলেছি, তারা যেন ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবে তুলে ধরেন। আর কেউ যেন সহিংসতার কথা না বলেন তা নিশ্চিত করতেও বলেছি। উগ্রপন্থাবিরোধী সচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের সন্ত্রাসী হওয়া প্রতিহত করছি।
দ্য হিন্দু: কয়েক দিন আগে আপনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা বলেছেন। আপনার এই ঘোষণা দিতে এত সময় লাগলো কেন, যখন অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন উগ্রগোষ্ঠী বহু হিন্দু এবং ব্লগারকে টার্গেট করে হত্যা করেছে?
শেখ হাসিনা: এটি সত্য নয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শুরু থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় সারবিশ্বেই তদন্তের জন্য সময় লাগে। কিন্তু এ কথা বলা ঠিক নয় যে এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমরা ধীরগতিতে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি।
দ্য হিন্দু: মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আইনশৃংখলা বাহিনী নিরাপত্তা সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের নিরাপত্ত হেফাজতে হত্যা, গুম এবং পায়ে গুলি করার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে সমর্থন হারাচ্ছে।
শেখ হাসিনা: এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সন্ত্রাসের শিকারদের চেয়ে দুষ্কৃতিদের অধিকারের পক্ষেই বেশি সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রে কী হচ্ছে? যখন সেদেশের স্কুল কিংবা অন্য কোথাও হামলা হয় তখন সেখানকার আইনশৃংখলা বাহিনী কী করে? তারা কি হামলাকারীদের হত্যা করে জনসাধারণকে উদ্ধার করে না? আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনী কি তাদের উপর হামলাকারীদের হত্যা করবে না?
দ্য হিন্দু: হলি আর্টিজানে হামলার পর আপনার সরকার বলেছে, হামলায় স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো জড়িত এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) জড়িত নয়। কিন্তু আইএসের দাবি, তারা এ হামলা করে এবং এ হামলার জন্য প্রধান সন্দেহভাজনকে তারাই প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের এ দাবি আপনি কিভাবে অস্বীকার করবেন?
শেখ হাসিনা: হয়তো হামলাকারীদের কেউ আইএসের প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের আইএসের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। এখানে আইএসের ঘাঁটি থাকার ব্যাপারে যদি কারও কাছে কোনও প্রমাণ থাকে, তাহলে তাদের উচিত এসব আমাদেরকে দেয়া। আমরা হামলাকারীদের চিহ্নিত করেছি, আমরা জানি তারা কোথায় থেকে এসেছে এবং তারা সবাই স্থানীয়।
দ্য হিন্দু: পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে দালালির জন্য যেসব ব্যক্তি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হয়েছে তাদের ফাঁসি বন্ধ করতে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকেই আহ্বান জানানো হয়েছে। ৪৫ বছর পরের এ সব ফাঁসি কি বাংলাদেশকে কোনো উপসংহারে পৌঁছে দিতে পারবে?
শেখ হাসিনা: অবশ্যই পারবে। ১৯৭১ সালে কী হয়েছে? তারা বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছে, দুই লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং গ্রামের পর পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। যারা এসব ঘটনার শিকার হয়েছেন তাদের দিক বিবেচনায় এসব ব্যক্তিদের বিচার করা ছিল জাতীয় দাবি।
দ্য হিন্দু: আপনি বলছেন এটি জনদাবি। এখন পর্যন্ত জামায়াতের নির্বাচিত নেতারা ফাঁসিতে ঝুলেছেন অথবা কারাগারে রয়েছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কর্মকর্তারা গ্রেফতার অথবা বিচার এড়াতে বিদেশে পালিয়ে আছেন। আপনি কি নিজের রাজনৈতিক রেষারেষির সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে গুলিয়ে ফেলছেন না?
শেখ হাসিনা: না। এটি আমার রাজনৈতিক রেষারেষির ব্যাপার নয়। আপনি যদি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন তাহলে আপনি এসব স্বাধীনতাবিরোধী নেতাদের সমর্থন করতে পারেন না। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। বিএনপি নেতাদের মামলা সম্পূর্ণ আলাদা, যা তাদের দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং এসব নেতা যদি দোষী না হয় তবে তাদের উচিত হবে বিচারের মুখোমুখি হওয়া। তাদের উচিত নয় দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া। আমি যখন বিরোধী দলে ছিলাম, তখন তারা আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মিথ্যা মামলা করেছিল। বিএনপি শুধু ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনই করেনি, একে বানচাল করারও চেষ্টা করেছিল। যেসব স্কুলে নির্বাচনী বুথ স্থাপন করা হয়েছিল, তা পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের কর্মীরা। তারা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করেছে। বাস-ট্রেন ধ্বংস করেছে। ২০১৫ সালে তারা তিন মাস ধরে সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে, যাতে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। কাজেই তাদের অবশ্যই আইনের মুখোমুখি হতে হবে। এখানে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই, সবগুলোই অপরাধ সংক্রান্ত মামলা।
দ্য হিন্দু: আপনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু এখন আপনি বিরোধী দলবিহীন একটি সংসদকে নেতৃত্বে দিচ্ছেন। আপনি কি পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপিকে সংসদীয় প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কিছু ভাবছেন?
শেখ হাসিনা: পরিণতির কথা জেনে-বুঝেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। আমি খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু তিনি আমার ফোন ধরেননি। আমার বাবা তার স্বামী জেনারেল জিয়াকে পদোন্নতি দেন এবং ওই সময় থেকে আমরা পরস্পরকে চিনতাম। কিন্তু, তিনি কটূ ভাষায় কথা বলেন। এমনকি তার ছেলের মৃত্যু হলে দরজা আটকে রেখে আমার সমবেদনা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি তার দলের নেতাদের প্রতিবাদের নামে সহিংসতা চালানোর নির্দেশ দেন। মানুষ হিসেবে আমি আর কী করতে পারি? নির্বাচন বর্জনের যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন তা তার ভুল ছিল। আমি আশা করি, তিনি পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে একই ধরনের ভুল করবেন না। তবে তিনি যদি দুষ্কৃতি করে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেন, আমি তার সুযোগ দেব না।
দ্য হিন্দু: সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের আরেকটি অংশ। তা সত্ত্বেও সম্প্রতি একজন খ্যাতিমান সম্পাদককে গ্রেফতার, মুক্তিযুদ্ধের অবমাননার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখে নতুন ডিজিটাল আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আপনি এই বার্তাই দিচ্ছেন যে আপনি সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছেন…
শেখ হাসিনা: আমি যখন ক্ষমতায় এলাম তখন একটিমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। আর এখন ২৩টি চ্যানেল। কে করেছে এগুলো? কে শত শত সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমোদন দিয়েছে? আর আমি জানতে চাই, যদি এখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাই না থাকে, তাহলে তারা স্বাধীনতা না থাকার কথা কিভাবে স্বাধীনভাব লিখছে। আমরা ওই সম্পাদককে (শফিক রেহমান) অন্য অপরাধে গ্রেফতার করেছি। তিনি যদি দেশের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালান, তাহলে তাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশে বহু সম্পাদক রয়েছেন, তাদের মধ্যে কতজন গ্রেফতার আছেন?
দ্য হিন্দু: চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ভারতে অনুষ্ঠেয় ব্রিকস-বিমসটেক সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সফর করছেন। চীনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ককে ভারত খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। খোলামেলা সম্পর্ক সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত চীনের চেয়ে পিছিয়ে আছে কেন?
শেখ হাসিনা: আসলে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বড় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিশেষ করে ভারত আমাদেরকে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা (২০০৭-০৮) দেয়ায় পরে হয়েছে। আগে আমরা ভারত থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতাম, কিন্তু এখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, একারণে বাণিজ্য হ্রাস পেতে পারে। এটি একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু এখনও ভারত থেকে আমরা অনেক কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি মেশিন ও তুলা আমদানি করছি। আমাদের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে জোরালো হবে।
দ্য হিন্দু: কিন্তু চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৬-৭ বিলিয়ন ডলারের…
শেখ হাসিনা: এটি প্রাইভেট খাতের ওপর নির্ভর করছে, তারা যেখান থেকে প্রয়োজন মনে করে সেখান থেকেই তারা পণ্য কিনতে পারে। দু’দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা নিয়ে বাংলাদেশ পুরোপুরি সোচ্চার রয়েছে। আমরা পর্যায়ক্রমে দু’দেশের বাণিজ্য বাধা তুলে নিতে চেষ্টা করছি। এছাড়াও আমরা মংলা এবং ভেড়ামারায় ভারতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন (এসইজেড) নির্মাণের পরিকল্পনা করেছি যা বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াবে এবং দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনবে।
দ্য হিন্দু: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা অংশীদার চীন। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগে বড় ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশ যে চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ বা মুক্তার মালার অংশ হচ্ছে বলে ভারতের যে উদ্বেগ রয়েছে তা কি যৌক্তিক নয়?
শেখ হাসিনা: আপনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। এটিই যদি আপনার মনোভাব হয়ে থাকে, তাহলে আপনি কিভাবে অভিযোগ করতে পারেন বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? না, আমাদের নীতি খুবই স্পষ্ট যে আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে এবং আমরা তা বজায় রাখতে চাই।আমি বিশ্বাস করি সুসম্পর্কের একটি বড় অংশ হলো কানেকটিভিটি। আমরা এরইমধ্যে বিআইএন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। ফলে ভুটান, ভারত এবং নেপালের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমরা চীন, ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গেও বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তুলছি। এর ফলে আমরা সবাই একযোগে নিজেদের বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতে পারব, যা আমাদের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে।
আমাদের জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে আমাদের এ অঞ্চলে কে সবচেয়ে বড় লাভবান হবে? ভারত। বাংলাদেশের বাজার থেকে সবচেয়ে লাভবান হওয়ার অবস্থানে রয়েছ ভারত। আপনাদের এটা বুঝতে হবে।
দ্য হিন্দু: এ সপ্তাহে আপনি ব্রিকস-বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত সফরে যাচ্ছেন। আশা করা যাচ্ছে এ বছরের শেষের দিকে একটি দ্বিপাক্ষিক সফরও করবেন। আমাদের বলুন আপনি কী অর্জনের আশা করছেন।
শেখ হাসিনা: আমাদের এ অঞ্চলের সমস্যা হলো আমাদের সবার অবস্থা একই। দারিদ্র্য আমাদের সবার শত্রু, যার মূলোৎপাটনে আমাদের সবাইকে লড়তে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নানা সমস্যা রয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি এটি সব সময় সমাধানযোগ্য। গঙ্গা পানি চুক্তির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ এমনটি করেছে। যতদূর জানি, ব্রিকস নেতারা আমাদের প্রত্যাশার কথা অবহিত আছেন। আমরা চাই ব্রিকস তার নতুন ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে বিমসটেকের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।
দ্য হিন্দু: এরই মধ্যে দু’দেশের মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে, যার ফলে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। এবারের সফরে আপনি কি অনিষ্পন্ন থাকা আরও সমস্যা যেমন- অবৈধ অভিবাসন ও সীমান্তে গুলি বন্ধ এবং সীমান্ত ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেবন?
শেখ হাসিনা: হ্যাঁ। সীমান্ত চুক্তি ছিল দীর্ঘদিনে ঝুলে থাকা সমস্যা যা ৪৫ বছর পরে নিষ্পত্তি হলো। সুতরাং যদি এমন বড় সমস্যার সমাধান হতে পারে তাহলে আমরা ছোটখাটো সমস্যাগুলোও সমাধান করতে পারবে। সীমান্ত হত্যা নিয়ে দু’পাশেই আমরা উভয় পক্ষই উদ্বিগ্ন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের নিরাপরাধ গ্রামবাসীদের গুলি করে হত্যার যেসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তা যৌথভাবে তদন্ত করতে সম্মত হয়েছে বিএসএফ এবং বিজিবি। দু’দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। কিছু সমস্যা যদিও এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন বিশ্বের মধ্যে আমরা কত বড় এবং ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করেছি যে আমরা সুনিপুণভাবে আমাদের জনগণ ও ভূমি বিনিময় করেছি।
দ্য হিন্দু: যদিও আপনার দ্বিপাক্ষিক সফরসূচি এখনও নির্ধারিত হয়নি…এখানে কি এমন কোনো প্রচেষ্টা রয়েছে যে আগে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে, তারপর দ্বিপাক্ষিক সফর হবে?
শেখ হাসিনা: না। এখানে কোনো শর্ত নেই। এমনকি রাষ্ট্রীয় সফর ছাড়াও আমি ভারতে গিয়েছি। আমি ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির স্ত্রীর শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছি। তার মৃত্যুর খবর শুনে আমি ছুটে এসেছি, কারণ ১৯৭৫ সালে তিনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত আমাদের জনগণের জন্য অনেক কিছু করেছে। তারা আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সুতরাং এসব বন্ধন থাকলে আপনি প্রটোকলের কথা ভাবতে পারবেন না। প্রতিবেশীর ঘরে আমি যেকোনো সময়েই যেতে পারি।
দ্য হিন্দু: আপনি কি মনে করেন সার্ক সাময়িক স্থগিত হয়ে যাওয়ায় জোট হিসেবে বিমসটেক অগ্রগতি অর্জন করবে?
শেখ হাসিনা: সার্ক একটি দক্ষিণ এশীয় জোট এবং তা এখনও বহাল রয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বঙ্গোপসাগরের আশেপাশের দেশগুলো নিয়ে ১৯৯৭ সালে বিমসটেক গঠিত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমিও এর একজন প্রতিষ্ঠাতা। নরেন্দ্র মোদি এই জোটকে আরও সামনের দিক এগিয়ে নিচ্ছেন, এজন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু কোনো জোট অপর কোনো জোটের বিকল্প আমি মনে করি না।
সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ