আমাদের জমি আমরা পাবো না কেন?
প্রকাশ | ২৯ মে ২০১৬, ০০:০৩ | আপডেট: ২৯ মে ২০১৬, ০০:৩১
“একশো দেড়শো বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষেরা এই দেশে বসবাস করে আসছে। তাহলে এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের অধিকার পাবো না কেন? আমাদের জমি আমরা পাবো না কেন? আমরা অন্য কোন দেশে যাবো না, আমরা এখানেই থাকতে চাই”
চা শ্রমিকের কৃষি জমি রক্ষা সংহতি কমিটি কর্তৃক আয়োজিত বাংলাদেশের ভূমি আইন ও চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার প্রসঙ্গ শীর্ষক সেমিনারে এই কথা বলেন হবিগঞ্জের চান্দপুরে নিজেদের ধানী জমি রক্ষার জন্য ইকোনমিক জোনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসা চা শ্রমিক কনকলতা রাজবংশী।
২৮ মে শনিবার বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর. সি. মজুমদার হল অডিটোরিয়ামে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারের শুরুতে চা শ্রমিকের কৃষি জমি রক্ষা সংহতি কমিটির পক্ষ থেকে প্রবন্ধ পাঠ করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
প্রবন্ধে উপমহাদেশের ইতিহাসে এদেশে চা শ্রমিকদের নিয়ে আসা ও তাদের বিভিন্ন সময়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হয়। চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবনের পাশাপাশি চান্দপুর-বেগমখানে ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা হলে তার বিভিন্ন নেতিবাচক ফলাফল ও চা বাগানের শ্রমিকদের আন্দোলনের বিভিন্ন কথাও উঠে আসে প্রবন্ধে। এছাড়া বাঁশখালিতে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টায় গুলি করে মানুষ হত্যা এবং গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে নামমাত্র মূল্যে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে চিনিকলের নামে নানা ধরণের ব্যবসা করার ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়।
প্রবন্ধে বলা হয়, চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানের যেসকল আইন কিংবা সরকারের ঘোষিত যে নীতি আছে তার সাথে সরকারের কর্মকাণ্ড পরস্পর বিরোধী হওয়ার কারণে চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
সেমিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, এলডিএফ এর পরিচালক আবুল হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট এর আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী, অধ্যাপক প্রশান্ত ত্রিপুরা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক বখতিয়ার আহমেদ, এলআরডির নির্বাহী সম্পাদক শামসুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হারুণ অর রশিদ। সেমিনারের সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন চা শ্রমিককের কৃষি জমি রক্ষা সংহতি কমিটির সমন্বয়ক এডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম।
আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী বলেন, এই শ্রমিকদেরকে চা শ্রমিক বলা হলে এদের ভূমি রক্ষার অধিকারটি প্রচলিত আইনে কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু এরা যেহেতু চা বাগানে কাজ করে তাই এদের চা শ্রমিক না বলে কৃষি শ্রমিক বলাই অধিকতর শ্রেয়। এর ফলে কৃষি শ্রমিক হিসেবেই এদের ভূমি রক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
সহযোগী অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্র ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বহুমাত্রিক সম্পর্ককে একমাত্রিক সম্পর্কে পরিণত করে। একজন মানুষকে ভূমির বিনিময়ে হয়তো অর্থ দেয়া সম্ভব। কিন্তু সেই ভূমিকে কেন্দ্র করে তার নানারকম আর্থিক কিংবা মানসিক সমর্থনের যে সম্পর্ক থাকে সেটা ফিরিয়ে দেয়া যায় না। তাই ভূমির বিনিময়ে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আসলে গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান নয়”।
তিনি আরো বলেন, “ব্রিটিশ আমল থেকেই ও পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সাথেও নিজের ভূমি রক্ষার বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তায় পরবর্তীতে তা প্রচ্ছন্ন করে রাখা হয়”।
এলআরডির নির্বাহী সম্পাদক শামসুল হুদা বলেন, “চা শ্রমিকদের জন্য তথা আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রতিষ্ঠা করা খুবই প্রয়োজন। কারণ প্রচলিত আইনে তাদের ভূমি রক্ষা আসলে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। ৯৭ ধারায় আদিবাসীদের জন্য যে আইন রাখা হয়েছে সেটাও আসলে অপ্রতুল কিংবা অকার্যকর”।
সুন্দরবন, বাঁশখালি সহ সারা দেশে ‘উন্নয়নের নামে অন্যায়ভাবে ভূমি অধিগ্রহণ’ এর বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন প্রতিবাদ করছেন তাদের সবাইকে নিয়ে একটি সমন্বয় কাঠামো তৈরির উপরেও জোর দেন তিনি।
দার্শনিকদের উক্তি উল্লেখ করে অধ্যাপক হারুণ অর রশিদ বলেন, “প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে ব্যক্তির শ্রম মিলে নৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। তাই চা শ্রমিকদের অধিকার নৈতিক অধিকার। তাদের এই অধিকার কেড়ে নেয়া মানবাধিকার পরিপন্থী, সংবিধান পরিপন্থী”।
প্যানেল আলোচকদের পরে নির্ধারিত বক্তার আলোচনায় চুনারুঘাট এর কনকলতা রাজবংশী বলেন, “২০১৪ সাল থেকেই আমরা আন্দোলন করে আসছি। আমাদের নিজেদের ভূমি অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত সরকারের সাথে লড়াই চলবে। বাংলাদেশে আমরা ১০০/১৫০ বছর ধরে আছি। তাহলে নাগরিক হিসেবে আমাদের জমি, আমাদের অধিকার পাবো না কেন? এটা আমাদের দেশ। আমরা এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমরা এই দেশেই আমাদের অধিকার চাই”।
শ্রীমঙ্গল বাসদ (খালেকুজ্জামান) এর নেতা আবুল হাসনাত বলেন, “যদিও গত ২৪ জানুয়ারি উপজেলা চেয়ারম্যান বলেছেন যে শ্রমিকদের মতের বিরুদ্ধে কিছু করা হবে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই নানাভাবে আন্দোলন বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে”।
মহিমাগঞ্জ ভূমি রক্ষা আন্দোলন এর সাধারণ সম্পাদক শাজাহান আলী প্রধান বলেন, “২০১৪ সাল থেকেই আমাদের সুগার মিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে ভূমি রক্ষার জন্য। কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়েই এই মিলের জন্য যাদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তার ৭০ ভাগ সাঁওতাল ও ৩০ ভাগ বাঙালি। লাভ করতে না পারায় ২০০৪ সালে মিলটি লে অফ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু লিজের শর্ত ভঙ্গ করে তারা মিলের জমি বর্গা দিয়ে আখের বদলে ধান তামাক এসব চাষ শুরু করে অনেক টাকা উপার্জন করে। কিন্তু যারা জমি হারিয়েছে তারা খেতে পারে না, থাকার জায়গা নেই। আন্দোলন এর মুখে ২ বছর ধরে মিলটি বন্ধ রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। এই দুই বছর ধরে ঢাকায় এসে মিছিল, মিটিং করেও এখনো পর্যন্ত জমি কিংবা কোন ক্ষতিপূরণ আমরা পাইনি”।
এছাড়াও আলোচনা করেন আদিবাসী যুব পরিষদ এর সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং। চা শ্রমিক তথা আদিবাসীদের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু করার ব্যাপারে আয়োজকদের অনুরোধ করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে হাসনাত কাইয়ুম বলেন, আমাদের আজ মূল আলোচ্য বিষয় ছিল প্রচলিতে আইনে এই ভুমির উপর চা শ্রমিকদের অধিকার আছে কিনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় চা শ্রমিকদের অবদান স্মরণ করে আমি দৃঢ়ভাবেই বলতে চাই, বিদ্যমান আইনেই চা শ্রমিকদের জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।