জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ ভাষণ (ভিডিও)
প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২২:৩০ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:১৮
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) ভোরে তিনি এ ভাষণ দেন। এতে আঞ্চলিক সন্ত্রাস নির্মূলে বাংলাদেশের সাফল্য, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বরাবরের ন্যায় এবারও তিনি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন।
জাতিসংঘের ৭১তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্ণ ভাষণ নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। জনাব সভাপতি, আসসালামু আলাইকুম এবং শুভ অপরাহ্ণ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় আপনাকে আন্তরিক এবং উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি। বিগত এক বছর সাধারণ পরিষদে অসাধারণ নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমি আপনার পূর্বসূরী মি. মগেনস লিকেটফ্ট্-কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
জনাব সভাপতি, জাতিসংঘ মহাসচিব মি. বান কি মুন এ বছর তার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মধ্যে অনেক বৈঠক এবং আলোচনা হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে সেগুলো স্মরণ করছি। তিনি সবসময়ই একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অর্জনগুলোকে বাকি বিশ্বের জন্য রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরেছেন। আমি তার এবং ম্যাডাম বান-এর অব্যাহত সাফল্য ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
জনাব সভাপতি, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে এই মহান সাধারণ পরিষদে বলেছিলেন, ‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য, তা এই উপলদ্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হবো।
আমাদের বিশ্ব বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যখন এ সকল অভিশাপ থেকে মুক্তি খুব একটা দূরে নয়। অনেক সৃজনশীল এবং প্রায়োগিক সমাধান এখন আমাদের নাগালের মধ্যে। প্রযুক্তি, নব্য চিন্তাধারা এবং বৈশ্বিক নাগরিকদের বিস্ময়কর ক্ষমতা আমাদের একটি ‘নতুন সাহসী বিশ্ব’ সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে। তবে এখনও আমাদের এই বিশ্ব উত্তেজনা এবং ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয়। বেশ কিছু স্থানে সহিংস-সংঘাতের উন্মত্ততা অব্যাহত রয়েছে। অকারণে অগণিত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। যারা সংঘাত থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন, প্রায়শঃই বিভিন্ন দেশ তাদের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করছে। কখনও কখনও অত্যন্ত জরুরী মানবিক চাহিদা অগ্রাহ্য করা হচ্ছে অথবা সেগুলো প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে।
কী অপরাধ ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া সিরিয়ার ৩ বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশু আয়লান কুর্দির? কী দোষ করেছিল ৫ বছরের শিশু ওমরান, যে আলেপ্পো শহরে নিজ বাড়িতে বসে বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে? একজন মা হিসেবে আমার পক্ষে এ সকল নিষ্ঠুরতা সহ্য করা কঠিন। বিশ্ব বিবেককে কি এসব ঘটনা নাড়া দিবে না?
গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে জাতিসংঘে অভিবাসী ও শরণার্থী বিষয়ক একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি আশা করি, এই সম্মেলনের ফলাফল বর্তমান সময়ে অভিবাসনের ধারণা এবং বাস্তবতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করবে। অভিবাসী ও শরণার্থীদের স্বদেশ এবং গন্তব্য উভয় স্থানের জন্যই সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত অভিবাসন সংক্রান্ত গ্লোবাল কমপ্যাক্ট-এর রূপরেখা প্রণয়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। আগামী ডিসেম্বর মাসে আমরা গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জিএফএমডি) আয়োজন করতে যাচ্ছি। এই ফোরামে আমরা অভিবাসন সম্পর্কিত সকল বিষয়ে গঠনমূলক সংলাপের প্রত্যাশা করছি।
জনাব সভাপতি, গতবছর অর্থাৎ, ২০১৫ সালে আমরা একটি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন এজেন্ডা- টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গ্রহণ করেছি। এই এজেন্ডার রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে পশ্চাৎপদ দেশগুলোর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ এবং অর্থবহ অবলম্বনে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। এজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিসমূহের সঠিক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তরণ সম্ভব। উদ্ভাবন এবং সম্ভাব্য সম্পদ সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদার করতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রস্তাবিত প্রযুক্তি ব্যাংক-কে দ্রুত কার্যকর করতে হবে।
আমরা ইতোমধ্যেই বেশিরভাগ এসডিজিগুলোকে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালায় সম্পৃক্ত করেছি। কাজের সমন্বয় ও যাচাইয়ের জন্য আমার তত্ত্বাবধানে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ চলমান রয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং শোষণমুক্ত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যে ‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়ন করছি, তার সঙ্গে এগুলোর সমন্বয় করা হয়েছে।
আমাদের লক্ষ্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, শক্তিশালী, ডিজিটাল এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেজন্য আমাদের সরকার উদ্ভাবনমূলক সরকারি সেবা বিতরণ, জনসাধারণের তথ্য লাভের অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও সেবা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
জনগণের দোরগোড়ায় ২০০ ধরনের সেবা পৌঁছে দিতে আমরা দেশব্যাপী প্রায় ৮ হাজার ডিজিটাল কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সারাদেশে ১৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মোবাইল ফোন এবং ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমেও এসব সেবা দেওয়া হচ্ছে। আগের তুলনায় আরও অধিক সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ এবং ডিজিটাল ল্যাব ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাস্তব ও পরাবাস্তব সংযোগের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি বিশ্বের সকল মানুষের জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিশ্বের সকল নাগরিকের কাছে ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সমবেত প্রয়াস কামনা করছি। সকলের দোরগোড়ায় ভয়েস ও ডাটা সংযুক্তি পৌঁছে দিতে আমাদের সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
জনাব সভাপতি, কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সংযোগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক আউটসোর্সিং-এর ক্ষেত্রে একটি উদীয়মান কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছে। আমাদের উন্নয়ন উচ্চাকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে আমরা বেশ কিছু বৃহাদাকার অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপাল (বিবিআইএন)-এর মধ্যে বাণিজ্য এবং নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে।
নিজস্ব অর্থায়নে আমরা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করছি। একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের আলোচনা চলছে। তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে।
সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে দেশব্যাপী একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
জনাব সভাপতি, সামষ্টিক এবং আর্থ-সামাজিক সূচকের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমাদের অব্যাহত উন্নয়ন অভিযাত্রাকেই সমর্থন করে। ২০১৫-’১৬ অর্থ-বছরে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দেশ যেখানে সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালের ৫৬.৭ শতাংশ হতে বর্তমানে ২২.৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ইউএনডিপি’র মানব উন্নয়ন ক্যাটাগরিতে মধ্যম এবং বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী নিম্ন মধ্যম-আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি।
বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও বিগত সাত বছরে আমাদের রপ্তানি আয় প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪.২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ বিলিয়ন থেকে সাড়ে আট গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণও তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষা, শোভন কর্মসংস্থান এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে অসমতা দূর করা আমাদের উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আমরা আমাদের বাজেটের প্রায় ১৩ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ করছি, যা আমাদের মোট জিডিপি’র ২.৩ শতাংশ।
জনাব সভাপতি, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অনেকগুলো উন্নয়ন অর্জনকে হুমকির মুখোমুখি করছে। ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটি অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি এবং জলবায়ু সম্পর্কিত ন্যায় বিচারের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এই জলবায়ু চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে। আমি আশা করি বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলি অতি সত্বর চুক্তিটিতে অনুসমর্থন জানাবে।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ করতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ‘ব্লু ইকোনমি’র সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও এর টেকসই ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পানি একটি সীমিত সম্পদ। অভিন্ন পানি সম্পদের বিচক্ষণ ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। সকলকে নিরাপদ ও সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধা প্রদান করতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ বিষয়ে সবাইকে অবশ্যই অবিচল থাকতে হবে। পানি সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের একজন সদস্য হিসেবে আমি এ বিষয়ে সর্বদা সোচ্চার থাকব।
জনাব সভাপতি, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রায় অর্ধ দশক পূর্বে নারী শিক্ষার উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফল আমরা পেতে শুরু করেছি। বাংলাদেশের নারীরা এখন উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন নারী এখন আমাদের প্রধানতম রপ্তানি খাত ‘তৈরি পোশাক’ শিল্পে কর্মরত। সকল পেশায় নারীর অংশগ্রহণের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্ভবতঃ বাংলাদেশ বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার এবং সংসদ উপনেতা সকলেই নারী। চলমান জাতীয় সংসদে আমাদের ৭০ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন, যা সংসদের মোট আসনের ২০ শতাংশ। ১২ হাজার ৫০০-এর বেশী নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় কাজ করছেন।
জনাব সভাপতি, গতবছর আমি বলেছিলাম, বর্তমান সময়ের দু’টি প্রধান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই চ্যালেঞ্জগুলো এখন কোন নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের সকল স্থানেই ছড়িয়ে পড়ছে। কোন দেশই আপাতঃদৃষ্টিতে নিরাপদ নয়, কোন ব্যক্তিই এদের লক্ষ্যবস্তুর বাইরে নয়।
আমেরিকা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে এশিয়ায় অগণিত নিরীহ মানুষ সন্ত্রাসবাদের শিকার হচ্ছে। আমরা মনে করি, সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই। এদেরকে সর্বোতভাবে সমূলে উৎপাটন করার সংকল্পে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদের মূল কারণগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। একইসঙ্গে এদের পরামর্শদাতা, মূল পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহকারী এবং প্রশিক্ষকদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিজে একজন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হিসেবে সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের দেশে যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপের উদ্ভব হয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয় করা, তাদের নিয়মিত অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম নির্মূল করার ক্ষেত্রে আমাদের সরকার সফল হয়েছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীচক্রের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় কিছু প্রান্তিক গোষ্ঠী তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পুনঃসংগঠনের মাধ্যমে নতুনরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকতে পারে।
বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। গত পহেলা জুলাই আমরা এক ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলার শিকার হই। ঢাকার একটি রেঁস্তোরায় কিছু দেশীয় উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী ২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এ সময় ১৩ জন জিম্মিকে আমরা উদ্ধার করতে সমর্থ হই। এই ভয়ঙ্কর ঘটনা বাংলাদেশের জনগণের মনে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।
বর্তমানে আমরা এই নতুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করতে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এতে সাড়া দেওয়ার জন্য আমি সমগ্র জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। আমরা সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। আমি আত্মবিশ্বাসী যে, জনগণের দৃঢ়তা ও সহযোগিতায় আমরা বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাসীদের সমূলে উচ্ছেদ করতে পারব। একইসঙ্গে আমি সন্ত্রাসী এবং উগ্রবাদীদের অর্থ ও অস্ত্র-শস্ত্রের যোগান বন্ধ এবং তাদের প্রতি নৈতিক এবং বৈষয়িক সমর্থন না দেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাচ্ছি।
জনাব সভাপতি, বাংলাদেশ জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি ‘শান্তির সংস্কৃতি’র বিস্তারের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাবে। শান্তি রক্ষা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অবদান অব্যাহত থাকবে। ঢাকায় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কেন্দ্র’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত সহিংসতার কবল থেকে বেরিয়ে আসা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ করে দিবে।
একইভাবে, আমরা নির্বিচারে হত্যার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা ও বিচার নিশ্চিত করতে জাতীয় বিচারিক প্রক্রিয়ার ভূমিকাকে গুরুত্ব প্রদানে সোচ্চার থাকব। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্থানীয় অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা বিগত কয়েক দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।
মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু ও ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি বৈরিতা নিরসনের জন্য সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলোকে অবশ্যই সঠিক দিকে পরিচালিত করতে হবে।
জনাব সভাপতি, বিশ্বায়নের এই যুগে আমদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে, যদি আমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন করি, তাহলে এখানে সম্ভাবনা ও সুযোগও রয়েছে প্রচুর।
‘এক মানবতার’ জন্য কাজ করার উদ্দেশে আমরা সকলে এখানে সমবেত হয়েছি। মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আসুন আমরা মানবতার স্বার্থে সকলে অভিন্ন অবস্থানে উপনীত হই এবং বিশ্ব থেকে সংঘাত দূর করে শান্তির পথে এগিয়ে যাই। এক্ষেত্রে জাতিসংঘই হতে পারে আমাদের জন্য একটি অনন্য প্লাটফর্ম। আসুন আমরা এই সংস্থাকে আরও টেকসই এবং প্রাসঙ্গিক করে তুলতে নতুন করে শপথ গ্রহণ করি। জনাব সভাপতি, আপনাকে ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।