ধর্ষিতার পরিবারকে হেনস্তা, ওসি প্রত্যাহার
প্রকাশ | ২১ মে ২০১৯, ১৭:০৩
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় ধর্ষণের মামলাকে কেন্দ্র করে ধর্ষিতার পরিবারকে হেনস্তার অভিযোগে মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাদীপক্ষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ মে (রবিবার) বিকেলে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
ভিকটিমের পরিবারের লোকেরা জানান, রাজশাহীর মোহনপুর সদরে নবম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আকতারকে (১৪) গত ২৩ এপ্রিল প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় মুখে রুমাল চেপে অপহরণ করা হয়। একই দিন বিকেলে তাকে অচেতন অবস্থায় উপজেলার বাগবাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর তাকে প্রথমে মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়।
কিন্তু এই ঘটনায় মামলা করতে গেলে মোহনপুর থানার ওসি আবুল হোসেন এর হেনস্তার শিকার হন তারা। ঐ কর্মকর্তা সুমাইয়ার মা ও বোনকে অপমান করেন বলে অভিযোগ করেন তারা। তাদের অভিযোগ, মামলা নিতে গড়িমসি করেন ওসি আবুল হোসেন। ঘটনার চার দিন পর পুলিশ সুপার নির্দেশ দেওয়ার পরে মামলা রেকর্ড করা হয়। কিন্তু সেখানেও রয়েছে অনেক গাফিলতি। অচেতন অবস্থায় ঐ স্কুলছাত্রীর পরনে অন্য পোশাক ছিল এবং বাড়ি থেকে যে পায়জামাটি তিনি পরে যান তাকে উদ্ধার করার পর তা পাওয়া যায়নি। কিন্তু মামলার অভিযোগে এ কথা উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি উল্লেখ নেই ধর্ষণের বিষয়টিও। এছাড়া ঘটনাস্থলে তিনজন উপস্থিত থাকলেও শুধু দুজনকে আসামি করা হয় এবং অপহরণের পর প্রধান আসামি মুকুলকে আটক করেও ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ।
সুমাইয়ার বোন জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, মামলার প্রধান আসামি মুকুল তার বোনকে যে চিঠি দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই চিঠিটিও খুঁজে পাওয়া গেছে। ঘটনার দিন প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় সুমাইয়ার বান্ধবী সোনিয়া এসে বলেছিল, সুমাইয়া নতুন যে জামা বানিয়েছে, ওটা যেন সঙ্গে নেয়। ওটা দেখে তার একজন বান্ধবী জামা বানাবে। কিন্তু যখন তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, তখন তার গায়ে ব্যাগের জামাটি পরানো অবস্থায় পাওয়া যায়। যে জামাটি তার পরনে ছিল সেটি তখন ধুয়ে নেড়ে দেওয়া ছিল। তার পরনে অন্য একটা পায়জামা ছিল এবং যেটা পরে গিয়েছিল, সেটি পাওয়াই যায়নি। এরপরও মামলায় ধর্ষণের প্রসঙ্গটি ঐ ওসি উল্লেখ করতে দেননি।
সুমাইয়ার মা ফরিদা বেগম বলেন, থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তাদের কথা শোনার আগেই আসামি সোনিয়ার মায়ের কথা শুনছিলেন। এ সময় সোনিয়ার মা তাদের পরিবার সম্পর্কে বাজে কথা বলছিলেন। প্রতিবাদ করতে গেলে ওসি তাকে ও তার আরেক মেয়েকে অপমান করেন। পরদিন ২৫ এপ্রিল সুমাইয়ার বাবা আবদুল মান্নান আবার মামলা করতে গেলে তাকেও অপমান করে বের করে দেন ওসি। এমনকি তাকে মেরে দাঁত ভেঙে দেয়ার হুমকি দেন ওসি। পরে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলমগীর কবিরের মাধ্যমে পুলিশ সুপারকে ফোন করা হলে তিনি ২৭ এপ্রিল সুমাইয়ার বাবাকে মেয়েসহ দেখা করতে বলেন। সব শুনে পুলিশ সুপার ওসিকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দিলে ঐ দিনই ওসি মামলা নেন, কিন্তু নিজের ইচ্ছামতো এজাহার লিখতে বাধ্য করেন। অপহরণের সময় দোলোয়ার নামের আরেকজন লোক উপস্থিত থাকলেও তার নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ধর্ষণের আলামত নষ্ট করে আসামিরা টাকা দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন নিজেদের পক্ষে নেয়ার পাঁয়তারা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
সুমাইয়ার বাবা আবদুল মান্নান বলেন, মামলার পর থেকে আসামিদের পরিবার নানা সময় তাদেরকে অপমান করতে থাকে। গত ১৭ মে বিকেলে সুমাইয়া চিরকুটে তার অপমানের কথা লিখে রাখে। চিরকুটে বাবা-মায়ের উদ্দেশে সুমাইয়া লিখেছে, ‘তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি, অনেক আদর, অনেক ভালোবাসা। কিন্তু একটা মেয়ের কাছে তার মানসম্মান সবচেয়ে বড়। নিজের লজ্জার কথা বারবার সবাইকে বলতে বলতে বলতে আমি নিজের কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছি। প্রতিদিন পরপুরুষের কাছে এসব বলতে বলতে আমি আর পারছি না। অপরাধীকে শাস্তি দিলেই তো আর নিজের মানসম্মান ফেরত পাব না। তাই আমাকে ক্ষমা করো।’ এরপর ঘর থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ ব্যাপারে রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি ) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ঐ স্কুলছাত্রীকে ওসিসিতে ভর্তি করা হয়েছিল। মামলার পরের দিনই তার ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয় তবে এখনো পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এই ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের অবহেলার বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমান সিদ্দিকীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি রবিবার বিকেল থেকেই কাজ শুরু করেছে।