পাঁচজন মিলে ৫ মিনিটেই আগুন দেয় নুসরাতকে
প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:১২
গত ৬ এপ্রিল পাঁচজন মিলে ৫ মিনিটের মধ্যেই ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় যার ফলশ্রুতিতে ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক নুসরাত। এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন এর জবানবন্দিতে উঠে এসেছে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের রোমহর্ষক বর্ণনা। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশেই যে সব করা হয়েছে তাও উঠে এসেছে আসামিদের জবানবন্দিতে।
গত ১৪ এপ্রিল (রবিবার) বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে হাজির করা হয় মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেনকে। সেখানে পর্যায়ক্রমে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তারা। শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম ২৫ পৃষ্ঠা এবং নূর উদ্দিন ৩০ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে ৬ এপ্রিল তার ওপর অগ্নিসন্ত্রাস চালানো পর্যন্ত সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দি অনুসারে পুরো ঘটনায় ২৫–২৬ জন জড়িত।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নিশ্চিত করেছে, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম, জোবায়ের আহমেদ, জাবেদ হোসেন, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন এবং কামরুন নাহার ওরফে মণি। এর মধ্যে মণি ছাড়া চারজনই গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং শাহাদাত হোসেন ফেনীর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে শাহাদাত জানান, নুসরাতকে হত্যার বিষয়ে গোপন বৈঠক হয় ৪ এপ্রিল রাতে। এসময় শাহাদাত ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন নুর উদ্দিন, হাফেজ আবদুল কাদের, জাবেদ, জোবায়ের, মহিউদ্দিন শাকিল, শামীম (২), ইমরান, ইফতেখার হোসেন রানা ও শরীফ। নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন শাহাদাত, নূর উদ্দিন ও কাদের। ৬ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন নুসরাতকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। থানা–পুলিশের বিষয়টি মাকসুদ (ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা) এবং রুহুল আমিন (উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) দেখবেন বলেও ঠিক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে শাহাদাত, জোবায়ের, জাবেদ, ও মণি সাইক্লোন শেল্টারের (তৃতীয় তলা ভবন) ছাদে অবস্থান নেন। শাহাদাত, জাবেদ ও জোবায়ের এর জন্য মণি তার বাড়ি থেকে তিনটি বোরকা নিয়ে আসেন আর কেরোসিন আনেন শাহাদাত। আর নুসরাতকে কৌশলে ডেকে আনেন উম্মে সুলতানা পপি। এসময় গেটে অবস্থান নেন আফসার ‘স্যার’, গেটের বাইরে নূর উদ্দিন, হাফেজ কাদের, ইমরান হোসেন মামুন ওরফে ইমরান, ইফতেখার হোসেন ওরফে রানা, মো. হোসেন ওরফে শরীফ। সাইক্লোন শেল্টারের নিচে পাহারায় ছিলেন মহিউদ্দিন শাকিল ও শামীম (২)।
জবানবন্দিতে শাহাদাত আরও বলেন, "নুসরাতকে নিয়ে পপি ছাদে উঠার পর সে মামলা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানালে তিনি নিজে পেছন থেকে এক হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরেন ও অন্য হাত দিয়ে হাত ধরেন। উম্মে সুলাতানা পপি তখন নুসরাতের পা এবং জান্নাত আফরোজ মনি নুসরাতের শরীর চেপে ধরেন। এরপর তিনজন মিলে নুসরাতকে মেঝেতে ফেলে দেন। জোবায়ের নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে হাত–পা বেঁধে ফেলে আর জাবেদ পলিব্যাগে থাকা কেরোসিন নুসরাতের পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢেলে দেয়। এরপর জোবায়ের ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়। নুসরাতের মুখ শামীম চেপে ধরায় সেখানে আর কেরোসিন ঢালা হয়নি। তাই পুরো শরীর পুড়লেও মুখে আগুন লাগেনি। এই পুরো ঘটনায় সময় লাগে প্রায় পাঁচ মিনিট। নুসরাতের গায়ে আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে শাহাদাত, জাবেদ ও জোবায়ের বোরকা খুলে কৌশলে পালিয়ে যান। আর মণি ও পপি ওরফে শম্পা পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়, কারণ তারা দুজনই নুসরাতের মতো আলিম পরীক্ষার্থী। আগুনে নুসরাতের প্রথমে পায়ের বাঁধন খুলে যায়, পরে হাতের বাঁধন খুলে যাওয়ার পর সে নিজেই চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে আসে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জানান, তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনায় জড়িত পরোক্ষদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করতে থানায় যাওয়ার পর নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়ায় ১৫ এপ্রিল (সোমবার) সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হয়েছে। এ মামলা তদন্তের জন্যও পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত।
উল্লেখ্য, শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি পুড়ে যাওয়া নুসরাতকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে এবং ঢামেকের বার্ন ইউনিটের আইসিউতে চিকিৎসা দেয়া হয়। তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঐ ছাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেয়ার কথা থাকলেও মেয়েটির শারিরীক অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় শেষ মুহুর্তে তা সম্ভব হয়নি।
গত ১০ এপ্রিল (বুধবার) রাতে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদী নুসরাত জাহান রাফি।