‘আদালতে আত্মসমর্পন না করলে করলে গ্রেপ্তার’
প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:৩১
আদালতে আত্মসমর্পন না করলে আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী যেকোন সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন ভিকারুননিসার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, শাখাপ্রধান জিনাত আখতার-ডিবির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর শ্রেণীশিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। বৃহস্পতিবার তাকে ঢাকা মুখ্য নগর হাকিম আদালতে পাঠানোর মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে। ৬ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উপকমিশনার খন্দকার নুরুন্নবী এ তথ্য জানান।
গত ৫ ডিসেম্বর (বুধবার) রাত ১১ টায় উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ভিকারুননিসার শিক্ষক হাসনা হেনাকে।
এর আগে ৫ ডিসেম্বর (বুধবার) অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে তাদের এমপিও বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
অভিযুক্ত তিন শিক্ষক হলেন-ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৗস, প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরা এবং শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনা।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে এই তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ অন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সেদিনের ঘটনা
অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী জানান, স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল অরিত্রীর। গত ২ ডিসেম্বর পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করায় নকলের অভিযোগ উঠে অরিত্রীর বিরুদ্ধে। এরপরই স্কুল কর্তৃপক্ষ দেখা করতে বলে অভিভাবককে। ৩ নভেম্বর (সোমবার) অরিত্রীর মা ও ছোট বোনসহ স্কুলে গেলে প্রথমে প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করি। তিনি সেসময় অকথ্য ভাষায় অপমান করেন এবং রুম থেকে বের করে দেন। সেই সাথে অরিত্রীর টিসি নিয়ে যেতে বলেন। এসময় অরিত্রী ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে ক্ষমা চায় কিন্তু তিনি কোন কথা-ই শোনেননি।
এরপর প্রিন্সিপাল নাজনীন ফেরদৌসের সাথে দেখা করলে তিনি একইভাবে অপমান করেন এবং রুম থেকে বের করে দেন। সেই সাথে স্কুল থেকে টিসি নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। যুগপৎ অপমানে কেঁদে ফেলি আমি। বাবার অপমান সইতে না পেয়ে অরিত্রী দ্রুত প্রিন্সিপালের রুম ত্যাগ করে। বাসায় এসে দেখি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছে সে।
অরিত্রীকে সেসময় সাথে সাথে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
তদন্ত কমিটি গঠন
৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সকালে সচিবালয়ে এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের পরিচালক মো. ইউসুফকে প্রধান করে মাউশির ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের উপ-পরিচালক শাথাওয়াত হোসেন ও ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার বেনজীর আহমেদকে নিয়ে এ তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুখোমুখি শিক্ষামন্ত্রী
৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাস পরিদর্শনে এসে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মন্ত্রীর গাড়ি অবরোধ করে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’শ্লোগান দেয়। এসময় শিক্ষার্থীদের শ্লোগানের মুখে শিক্ষামন্ত্রী গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলেন এবং বিচারের আশ্বাস দেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, স্কুলের শিক্ষকের কথায় অপমানে ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মবেদনাদায়ক। এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন, প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে-বললেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী কতটা অপমানিত হলে, কতটা কষ্ট পেলে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়? ঘটনা এবং ঘটনার পিছনের কারণ খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
স্কুলের প্রভাতী শাখার প্রধানকে অব্যাহতি
নবম শ্রেনীর ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাতী শাখার প্রধান জিনাত আরাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস বলেন, জিনাত আরাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ম্যানেজিং কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে। এসময় তিনি মন্ত্রণালয়ের বাইরেও নিজেরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছেন বলে জানান। তবে অরিত্রীকে টিসি দেওয়া নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, সে অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ, অভিভাবকদের অভিযোগ
সহপাঠীর আত্মহত্যার ঘটনায় ৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সাড়ে ১১টার দিকে ক্ষুব্ধ ছাত্রী ও অভিভাবকেরা বেইলি রোডে কলেজের ফটকে জড়ো হন এবং দিনভর বিক্ষোভ করে সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। এখানেও শিক্ষার্থীদের শ্লোগান ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। সেই সাথে শ্লোগানে মুহর প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্কুলের মূল ফটকে প্রতিবাদ জানান। সেখানে চিল- ‘একি শুধু আত্মহত্যা?’, ‘সুইসাইড মানে কি শুধুই প্রেমে ব্যর্থতা?, ‘স্কুল কিলস স্টুডেন্টস’, ‘আমরা আর অরিত্রী চাই না’। বিকেলে ৫ টার দিকে তারা আগামী ৫ ডিসেম্বর বুধবারের সব পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয়। সেই সাথে বুধবার সকাল ১০টায় কলোব্যাজ ধারণ ও ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান, প্রচলিত আইনে সহপাঠীর আত্মহত্যার বিচার এবং গভর্নিং বডিসহ অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবির কর্মসূচি দেয় শিক্ষার্থীরা।
এ প্রসঙ্গে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আনুশকা বলেন, বুধবারের সব পরীক্ষা বর্জন ঘোষণা করছি। যদি পরীক্ষা নেওয়া হয় তাহলে আমরা তা হতে দেবো না। আমাদের সহপাঠীকে হারিয়েছি। আর কাউকে এভাবে অকালে হারাতে চাই না।
অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, বর্তমান কমিটি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা এই গভর্নিং বডির পদত্যাগ চাই।
অভিভাবকদের অভিযোগ
স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনোই কোনো অভিভাবকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না বলে অভিযোগ করেন অভিভাবকরা। অতিরিক্ত ফি নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বাধ্যতামূলকভাবে আলাদা আলাদা বিষয়ে সবাইকে কোচিং করতে হয় বলে অভিযোগ করেন অনেক অভিভাবক।