‘সংগঠিত হতে হবে আমাদের সবাইকে’
প্রকাশ | ২৩ মে ২০১৬, ২১:৩২ | আপডেট: ২৩ মে ২০১৬, ২২:০৯
মসজিদের মাইকে ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে নারায়নগঞ্জে স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে জনসমক্ষে অপমান করার প্রতিবাদে এবং নির্যাতক সেলিম ওসমান এর বিচার দাবিতে ২৩ মে সোমবার বিকেল ৫টায় শাহবাগে সংহতি সমাবেশ ও সেলিম ওসমানের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-শিক্ষার্থী-সাংস্কৃতিক কর্মীবৃন্দ।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহ’র সঞ্চালনায় সংহতি সমাবেশে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে একজন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তুলে তাকে সবার সামনে কান ধরে উঠবস করানোর তীব্র প্রতিবাদ করেন বক্তারা। একই সাথে এই জঘন্য ঘটনা ঘটানোর জন্য সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের বিচার দাবি করেন তারা।
সমাবেশে লেখিকা অদিতি ফাল্গুনী বলেন, “পাকিস্তান আমলে যেমন ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষের উপর অত্যাচার করা হতো, এখনো তাই ঘটছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে আজ স্বাধীন দেশেও ধর্ম অবমাননার কথা বলে একজন স্কুল শিক্ষককে অপমান করছেন একজন সংসদ সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে আমাদের প্রথম সংবিধান এর যে ৪টি মূলনীতি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালী জাতীয়বাদ ও সমাজতন্ত্র সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। তাই এই অপমান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অপমান”।
অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা বলেন, “বর্তমান অবস্থা পূর্বের যেকোন অবস্থার চেয়েও খারাপ। ব্রিটিশরা এবং পাকিস্তানিরা আমাদের মাঝে ধর্মের নামে যে বিভেদ তৈরী করার চেষ্টা করেছিল আমরা দেখছি এখনকার ক্ষমতাসীনরাও সেই একই কাজ করছেন। পান থেকে চুন খসলেই এখন ধর্ম অবমাননার কথা বলা হয়, জনসম্মুখে শিক্ষককে লাঞ্ছনা করা হয় অথচ কোন বিচার হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল আর ইসলামী দলগুলো আজ মিলেমিশে একাকার। এই অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের সবাইকে আবারো মুক্তিযুদ্ধের মতো এই সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে”।
সিপিবির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবিব লাবলু বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারে দায়িত্ব নেন, কিন্তু শ্যামল কান্তি ভক্তের দায়িত্ব নেন না। আমরা দেখছি মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন, কিন্তু সেটার বাস্তবে কোন প্রতিফলন নেই। আমরা দেখছি সেই ওসমান গং এখন ইসলামী দলকে মাঠে নামিয়েছে। এভাবে ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে বিভেদ এর দেয়াল তুলে দিচ্ছে তারা”।
তিনি আরো বলেন, “আমরা এখন ডাক্তার দেখি, ইঞ্জিনিয়ার দেখি, ব্যারিস্টার দেখি কিন্তু মানুষ দেখি না। মানুষের বড় অভাব এখন দেশে। তাই মানুষের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াইয়ে আমি সব মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মানুষেরা সংগঠিত হলেই কেবল এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব”।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা বলেন, “এটা শুধুমাত্র কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়, বরং আমাদের শাসকতন্ত্রের যে একনায়কতন্ত্র ও সন্ত্রাসী নীতি তারই প্রতিফলন। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় না থাকলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা যাবে না এমন একটি ধারণা মানুষের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে এই সরকার আরো বেশি একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠছে”।
সিপিবির কেন্দ্রীয় সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “আমরা একাত্তরে যখন মুক্তিযুদ্ধ করি তখন আমরা বলতাম ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’। আর আজ মানুষের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে গেছে। শুধু শ্যামল কান্তি নয়, বাগেরহাট সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকদের উপর আক্রমন হচ্ছে, তাদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। কিন্তু কোন ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। আপনারা যদি বাঁশখালির দিকে তাকান, তনু হত্যার ঘটনা দেখেন তাহলে দেখবেন কিভাবে এই শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে লালনপালন করছে”।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আরো বলেন, “এই পরিস্থিতির উত্তরণে আজ আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। শুধু ঢাকা কিংবা নারায়নগঞ্জ নয়, বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে, সব শহরে এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি সারাদেশে এরকম ব্রিগেড গড়ে তোলার জন্য আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি। সেই আন্দোলনে আমরা সবাই একসাথে লড়বো এটাই প্রত্যাশা থাকবে”।
সংহতি সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক যুবনেতা শিশির, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিনু কিবরিয়া ইসলাম প্রমুখ।
এছাড়াও সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ, সাংবাদিক নেতা পুলক ঘটক, সাংবাদিক সাকিল অরণ্য, লেখক ও গবেষক দীপঙ্কর গৌতম, আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত, সাবেক ছাত্রনেতা আকরামুল হক, সাবেক ছাত্রনেতা খান আসাদুজ্জামান মাসুম, সাবেক ছাত্রনেতা মানবেন্দ্র দেব, উদীচীর কেন্দ্রীয় সদস্য কংকন নাগ, ছাত্র ইউনিয়ন এর কেন্দ্রীয় সভাপতি লাকী আক্তার প্রমুখ।
সমাপনী বক্তব্যে আয়োজকদের পক্ষে শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান বলেন, “শ্যামল কান্তি ভক্তের ঘটনার সময় প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে ছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম দেশে ফিরে তিনি এই ব্যাপারে কিছু বলবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি এখনো এই ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। আমরা সরকারের কাছে জানতে চাই তারা কি শিক্ষক লাঞ্ছনাকারী, সন্ত্রাসী ওসমানদের সাথে থাকবেন নাকি শ্যামল কান্তির মতো নিরীহ জনগণের পাশে থাকবেন?”।
বক্তব্যের শেষে আয়োজকদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি ৫ দফা দাবি পড়ে শোনান তিনি। ৫ দফা দাবি হচ্ছে,
১. সাংসদ সেলিম ওসমান ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির দোষী সদস্যদের গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে।
২. শ্যামল কান্তি ভক্ত এর বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে পুনর্বহাল এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা ইউনিয়নের দণ্ডপ্রাপ্ত দুই শিক্ষকের মুক্তি ও তাদের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার এবং পুনর্বহাল করতে হবে।
৪. ধর্মীয় উস্কানি প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. সারাদেশে ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, পুরোহিত, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও বৌদ্ধভিক্ষু হত্যার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
সমাবেশের শেষে সেলিম ওসমানের একটি প্রতীকী কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।