‘একাত্তরের জননী’ রমা চৌধুরীর মৃত্যুতে মন্ত্রিসভার শোক
প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:৩৮
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্যাতনের শিকার এবং অসীম সাহসী নারী ‘একাত্তরের জননী’ হিসেবে সমধিক পরিচিত বিশিষ্ট লেখক বীরমাতা রমা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে মন্ত্রিসভা।
১০ সেপ্টেম্বর (সোমবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের শুরুতেই শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এ তথ্য জানিয়েছেন।
এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ‘একাত্তরের জননী’রমা চৌধুরী। ০৩ সেপ্টেম্বর বেলা সোয়া ১২টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রমা চৌধুরী। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। এ সময় তিনি বোয়ালখালীতে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তার স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। তাঁকে জোর করে নিয়ে যায় পাশের নির্জন ঘরে। হারান সম্ভ্রম। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক এক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান। সম্ভ্রম হারানোর পর তাদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে যখন আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়েছেন, তখন হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাঁকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। এসব ঘটনার বিবরন পাওয়া যায় তার লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থে।
জয়লাভের পর ২০ ডিসেম্বর তাঁর বড় ছেলে সাগর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর ১ মাস ২৮ দিন পর মারা যায় আরেক ছেলে টগর। এরপর তিনি জুতা পরা বাদ দেন। পরে অনিয়মিতভাবে জুতা পরতেন তিনি। ফটিকছড়িতে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৮ সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত। সেখানে নানা ধরনের চক্রান্তে পড়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর আর চাকরি করেননি কোথাও। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় আরেক ছেলে মারা গেলে পুত্রশোকে তিনি আর জুতা পায়ে দেননি।
তবু জীবনযুদ্ধে হার মানেননি এ বীরমাতা। শুরু করেন নতুনভাবে পথচলা। ২০ বছর ধরে লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। এ পর্যন্ত তিনি ১৫টি বই লিখেছেন। খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই বিক্রি করে চলতেন এই নারী। কারো কাছ থেকে তিনি কোন আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য নেননি এখন পর্যন্ত। শুধুমাত্র তার কাছ থেকে বই কিনলেই টাকা নিয়েছেন, এ ছাড়া নয়।
গত প্রায় ৪ বছর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে রমা চৌধুরীর ব্যাপারে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই গণভবনে তার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন রমা চৌধুরী, তবে কোনো ধরনের সাহায্য নেবেন না এ শর্তে। এ সময় রমা চৌধুরীর মুখে তার সব হারানোর কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী।
আজীবন সংগ্রামী এই বীরমাতার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র।