বীরমাতা রমা চৌধুরীকে গার্ড অব অনার

প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৪৮

জাগরণীয়া ডেস্ক

সদ্য প্রয়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্যাতনের শিকার এবং অসীম সাহসী নারী ‘একাত্তরের জননী’ হিসেবে সমধিক পরিচিত বিশিষ্ট লেখক বীরমাতা রমা চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছে।

০৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার) বেলা সোয়া ১২টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এ সম্মাননা দেওয়া হয়।

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রমা চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে নিয়ে আসলে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষ মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

একাত্তরের এ বীরাঙ্গনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগরের কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম, ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান, লেখক ও শহীদজায়া মুশতারি শফী, মুক্তিযোদ্ধা অমল মিত্র, অধ্যক্ষ রীতা দত্ত, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, ভারপ্রাপ্ত সিটি মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ান, নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু, চসিক কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, শৈবাল দাশ সুমন, সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন, কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত‍া মোহাম্মদ মহসীন, নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু, জেলা শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রনজিৎ রক্ষিত, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সহ-সভাপতি ডা. চন্দন দাশ, সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, ওয়াকার্স পার্টি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান প্রমুখ।

এছাড়াও ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সম্মিলিত আবৃত্তি জোট, গণজাগরণ মঞ্চ, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চা পরিষদ, কৃষ্ণকুমারী সিটি করপোরেশন স্কুল, অর্পণাচরণ সিটি করপোরেশন স্কুল, মিউনিসিপ্যাল সিটি করপোরেশন স্কুল, পাহাড়িকা স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ।

‌এসময় ‘একাত্তরের জননী’ খ্যাত বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে জহর চৌধুরী, রমা চৌধুরীর দীর্ঘদিনের সহচর ও তার বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দীন খোকন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ০৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

‘একাত্তরের জননী’ খ্যাত বীর মাতা রমা চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ত‍্যাগ ও সংগ্রামের কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন। তিনি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।

প্রসঙ্গত ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রমা চৌধুরী। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। এ সময় তিনি বোয়ালখালীতে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তার স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। তাঁকে জোর করে নিয়ে যায় পাশের নির্জন ঘরে। হারান সম্ভ্রম। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক এক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান। সম্ভ্রম হারানোর পর তাদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে যখন আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়েছেন, তখন হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাঁকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। এসব ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তার লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থে।

জয়লাভের পর ২০ ডিসেম্বর তাঁর বড় ছেলে সাগর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর ১ মাস ২৮ দিন পর মারা যায় আরেক ছেলে টগর। এরপর তিনি জুতা পরা বাদ দেন। পরে অনিয়মিতভাবে জুতা পরতেন তিনি। ফটিকছড়িতে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৮ সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত। সেখানে নানা ধরনের চক্রান্তে পড়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর আর চাকরি করেননি কোথাও। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় আরেক ছেলে মারা যায়। পুত্রদের মৃত্যুর পর তিনি তাদেরকে হিন্দু ধর্মমতে দাহ না করে মাটিতেই সমাহিত করেছিলেন এবং তারপর থেকে পায়ে আর জুতা পরেননি দুঃখিনী এই মা। যে মাটির নিচে তার ছেলেরা ঘুমিয়ে আছে সেই মাটিতে তিনি জুতা পায়ে হাঁটতে পারেন না এমনটাই বলেন রমা চৌধুরী।

তবু জীবনযুদ্ধে হার মানেননি এ বীরাঙ্গনা। শুরু করেন নতুনভাবে পথচলা। ২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। এ পর্যন্ত তিনি ১৫টি বই লিখেছেন। এর মধ্যে ‘একাত্তরের জননী’ বইটির প্রথম খণ্ড ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এটি মূলত তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই বিক্রি করে চলতেন এই নারী। কারো কাছ থেকে তিনি কোন আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য নেননি এখন পর্যন্ত। শুধুমাত্র তার কাছ থেকে বই কিনলেই টাকা নিয়েছেন, এ ছাড়া নয়।

আজীবন সংগ্রামী এই বীর মাতার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত