ডিমলায় গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু, লাশ নিয়ে বাণিজ্য
প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০১৬, ১৫:৩৯
নীলফামারী জেলার ডিমলায় নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। গৃহবধূর মৃত্যুর পর স্বামী ও শ্বশুরকে নিহতের বাবার বাড়ির লোকেরা বেঁধে রাখলেও কয়েক ঘণ্টা পর দুই ইউপি চেয়ারম্যান, এক ইউপি সদস্যের লাশ নিয়ে মোটা অংকের বাণিজ্যের পর তা রফাদফার অভিযোগ উঠেছে। এদিকে কোন রকম ময়নাতদন্ত ছাড়াই গৃহবধূর লাশ দাফন সম্পন্ন হয়।
বুধবার (২৭ জুলাই) উপজেলার নাউতরা ইউনিয়ন আকাশকুড়ির গোদার বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক বছর আগে উপজেলার গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ৫নং ওয়াড কলেজপাড়া গ্রামের বাসীন্দা আকবর আলী পেট্টুর মেয়ে মোছাঃ ছালেয়া বেগমের (১৫) সঙ্গে ওই উপজেলার নাউতরা ইউনিয়নের আকাশকুড়ি (গোদার বাজার) গ্রামের নইজার উদ্দিনের ছেলে জসিম উদ্দিনের (২০) বিয়ে হয়। বিয়েতে যৌতুক হিসেবে চল্লিশ হাজার টাকা নগদ দেওয়া হলেও আরও টাকা দাবি করে স্বামী জসিম প্রায়ই গৃহবধূ ছালেয়াকে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। গত মঙ্গলবার সকালে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলে স্বামী জসিমকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু জসিম ডাক্তারের কাছে না নিয়ে বরং উল্টো স্ত্রী ছালেয়াকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে বাবার বাড়ি থেকে চিকিৎসার টাকা এনে ডাক্তারের কাছে যেতে বলেন। স্ত্রী ছালেয়া বেগম তার প্রতিবাদ করায় জসিম ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাতাড়ি তাকে পেটাতে থাকেন। একপর্যায়ে গৃহবধূ পেটে আঘাত পেলে শুরু হয় রক্তক্ষরণ। ঘটনা বেগতিক বুঝতে পেরে স্বামী জসিম ও শ্বশুর নইজার উদ্দিন কাদায় পা পিচলে পড়ে পেটে আঘাত পেয়েছেন বলে মিথ্যে তথ্য দিয়ে ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। সেখানে মঙ্গলবারই বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গৃহবধূ ছালেয়ার মৃত্যু হয়।
এদিকে সন্ধ্যায় তার লাশ বাবার বাড়ি নিয়ে গেলে স্বামী ও শশুর নিজেদের বাঁচাতে তাড়াতাড়ি লাশ দাফনের পায়তারা করলে নিহত গৃহবধূর বাবার বাড়ির লোকরা ও এলাকাবাসী তাদের দুজনকেই মেয়ের খুনি আখ্যা দিয়ে বেধে রাখেন। দীর্ঘ সময় বেঁধে রাখবার পর স্বামী জসিমের এলাকা ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম লেলিন, একই উপজেলার নিহতের বাবার বাড়ির গয়াবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ইবনে ফয়সাল মুন ও ওয়াডের ইউপি সদস্য (মেম্বর) আমজাদ হোসেনসহ প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে উভয়পক্ষকে নিয়ে মঙ্গলবার রাতে গয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে গৃহবধূর বাবা পরিবারকে ভয়ভীতি, প্রলোভন দেখিয়ে ও চাপ প্রয়োগ করে প্রকাশ্যে একচল্লিশ হাজার টাকায় বিনিময়ে মীমাংসা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত থাকা এক ব্যাক্তি বলেন, নিহতের পরিবার একচল্লিশ হাজার টাকা জানলেও বিষয়টি রফাদফা হয়েছে তার চেয়েও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। নিহতের পরিবার আংশিক ওই টাকা পাবেন, আর বাকি পুরো টাকাটাই যাবে বিচারক নামের ওইসব প্রভাবশালী চেয়ারম্যান-মেম্বারের পকেটে।
এবিষয়ে গয়াবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মুনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
বৈঠকের বিষয়ে নাউতরা ইউপি চেয়ারম্যান লেলিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমিও আপোষের পক্ষে ছিলাম না, এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে ছেলে ও তার বাবার খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু মুন চেয়ারম্যান জোর করে একেবারে আপোষ করে ফেললেন।
টাকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একচল্লিশ নয় একুশ হাজার টাকার বিনিময়ে আপোষ করা হয়েছে। এই টাকাটা অসুস্থ গৃহবধূর চিকিৎসা তার স্বামী কোনো রকম ব্যয় না করায় তা জরিমানা বাবদ দেওয়া হয়েছে। এবং বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ার কারণে রাতেই দাফন না করে সকালে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে পুনরায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই লাশ দাফন করবার কথা বলা হয়। মেয়ের পরিবার গরীব দেখে বিষয়টি এখানেই ইতি টানার জন্য বলা হয়।
এদিকে রাতে নিহত গৃহবধূর মা হামিদা বেগম কান্নায় জর্জরিত অবস্থায় সাংবাদিকদের মেয়ের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানাতে চাইলে পরিবারের অন্য পুরুষ সদ্যসরা তাকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতের দূরসম্পর্কের এক আত্নীয় অভিযোগ করে বলেন, নিহত ছালেয়াকে মাঝে মধ্যে স্বামীসহ শশুর বাড়ির লোকেরা কারণে-অকারণে যৌতুকের টাকার জন্য অমানসিক নির্যাতন করত। ঘটনার দিনেও তাকে অনেক মারধর করা হয়েছে। এমন কি তার শরীরের আঘাতের দাগ রয়েছে।
এ বিষয়ে ডিমলা থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন দায়সারা ভাবেই বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না, আমাকে কেউ অভিযোগ করেনি। তিনি আপোষের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, আঘাতে মৃত্যু হলে তো লাশ রংপুর মেডিকেলেই আটক করে দিত।
ওসির এমন দায়সারা যুক্তিতে এলাকাবাসীর অনেকের অভিযোগ পুলিশ অনেক সময় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করা লাশকেও রহস্যজনক আখ্যা দিয়ে ময়নাতদন্ত করলেও নিহত গৃহবধূর লাশ ময়নাতদন্ত কেন করা হবে বলে জানতে চায়। তাদের ধারণা ময়নাতদন্তের মাধ্যমেই মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।