গুলশান হামলা
২ নারীর মোবাইল ব্যবহার করে জঙ্গি সহায়তায় হাসনাত-তাহমিদ!
প্রকাশ | ২২ জুলাই ২০১৬, ১৪:৫১
গুলশানে জঙ্গি হামলায় ২ বিদেশি নারীর মোবাইল নিয়ে অ্যাপস ডাউনলোড করে জঙ্গিদের সহায়তা করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম। এছাড়া বিভিন্নভাবেই এই ব্যক্তির জঙ্গিদের সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখন অনেকটা স্পষ্ট। শুধু হাসনাত করিমই নয়, তদন্তে গোয়েন্দাদের জালে ফেঁসে গেছেন কানাডা প্রবাসী শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানও।
গুলশানের রেস্তোরাঁ ও আশপাশের সিসিটিভির ১০ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে রেকর্ড হওয়া ফুটেজ ও জঙ্গিদের ধারণ করা মোবাইলের ভিডিও থেকে এসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খান বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেও নিজেদের আর জঙ্গি কানেকশন থেকে মুক্ত বলে প্রমাণ করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সূত্রে ভিডিওগুলোর বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও তদন্তের স্বার্থে সব বিষয়ে জানা যায়নি। তবে হাসনাত করিম গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ ঠাণ্ডা মাথায় নানা কৌশলে ফেস করতে চাইলেও বারবার জড়িয়ে পড়ছেন নিজেরই উত্তরে। এছাড়া এড়িয়ে যাচ্ছেন গোয়েন্দাদের অনেক প্রশ্নও। ফলে নিজেকে একেবারেই নির্দোষ প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছেনা হাসনাত করিমের। একই অবস্থা কানাডা প্রবাসী শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানেরও, বারবার জড়িয়ে পড়ছেন গোয়েন্দাদের জালে।
মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) সরকারের শীর্ষপর্যায়ের এক বৈঠকে গুলশান হামলার সর্বশেষ অগ্রগতি সবিস্তারে তুলে ধরা হয়। আলোচনা হয় গুলশান হামলার সময় পুলিশের দায়িত্ব পালন ও সক্ষমতা নিয়ে।
গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বলেন, হামলার সময় গুলশান জোনের একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে ৫ রাউন্ড গুলি করার পর অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কারণ, তার কাছে ওই সময় আর কোনো গুলি ছিল না। এছাড়া দুর্ভাগ্যের বিষয়, কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই পুলিশ প্রথমে অপারেশনে নামে।
সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে পাঁচ সদস্যের জঙ্গি দল প্রবেশ করার সময় প্রথমেই একটি গ্রেণেড চার্জ করে। রাত ৮টা ৪৬ মিনিটে এটি মূল ফটকের সামনে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলে রেস্তোরাঁটির ভেতর-বাইরে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে সবাই। সন্ত্রাসীরা কোনো সময় না দিয়ে রেস্তোরাঁর মধ্যে ঢুকেই গুলি করতে শুরু করে। এ সময় প্রথমে তারা বিদেশিদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। রেস্তোরাঁর গোলাকার আকৃতির একটি কক্ষে খাবার টেবিলে বসে থাকা জাপানি এবং ইতালিয়ান নাগরিকরা প্রথমে হত্যার শিকার হন। এরপর রেস্তোরাঁর ডানপাশে পৃথক টেবিলে বসে থাকা শিল্পপতি লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আয়াজ হোসেন, তার বন্ধু ল্যাভেন্ডার সুপারশপের মালিক এহসানুল কবিরের মেয়ে অবিন্তা কবির এবং ভারতীয় নাগরিক তারশী জৈনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গোলাগুলির সময় রেস্তোরাঁটির দক্ষিণ গেট দিয়ে দেশি-বিদেশি ২০ থেকে ২৫ জন বেরিয়ে যেতে সক্ষম হলেও আটকে পড়েন এক ইতালিয়ান নাগরিক ও এক বাংলাদেশি। ইতালিয়ান ওই নাগরিককে হত্যা করলেও পরিচয় জেনে ছেড়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশি নাগরিককে।
জঙ্গিরা রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই গুলি করে হত্যার পরেও পৈশাচিকতা প্রকাশ করতে বিদেশিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে। মৃতদেহগুলোতে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যার বীভৎসতা তৈরি করে। বিশেষ করে ওই জঙ্গিরা হত্যার শিকার নারীদের ওপর বেশিমাত্রায় পৈশাচিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
একপর্যায়ে দেখা যায়, তারা মৃত ইতালিয়ান নাগরিক ক্লদিয়া মারিয়া দান্তনার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেটটি তুলে নেয়। একই সময় জিম্মিদের মধ্যে জীবিত শ্রীলংকার নাগরিক প্যাপথা সায়মার স্মার্টফোন সেটটি নিয়ে নেয় জঙ্গিরা। এরপর এ ২টি মোবাইল সেট হাসনাত করিমের হাতে দিয়ে কি যেন বলে জঙ্গিরা।
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা হাসনাত করিমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, জঙ্গিরা তাকে ‘উইকার’ ও ‘থ্রিমা’ নামে ২টি অ্যাপস ডাউনলোড করে দিতে বলেছিল। তিনি প্রাণভয়ে ওই ২টি অ্যাপস নামিয়ে দেন। তবে হোটেলটিতে জিম্মি থাকাবস্থায় ভোর পর্যন্ত হাসনাত করিমকেও মোবাইল ফোন সেট খুবই স্বাভাবিকভাবেই ব্যবহার করতে দেখা গেছে। সিসিটিভি ফুটেজে এর প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
আর এই অ্যাপসের মাধ্যমে জঙ্গিরা বিদেশীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ছবি ও ভিডিওচিত্র মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি উগ্রপন্থী সংগঠনের মুখপত্র ‘আমাক’ নিউজ এজেন্সির কাছে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ওইসব ছবি ও ভিডিও চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্সের স্বত্বাধিকারী রিটা কাৎসের কাছে।
আবার এদিকে রেস্তোরাঁটিতে হাসনাত করিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে দেখা গেছে তাহমিদ হাসিব খানকে। যিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর শিক্ষার্থী। এমনকি একপর্যায়ে হাসনাত করিম, তাহমিদ খান ও নিহত জঙ্গি নিবরাসকে একসঙ্গে হোটেলটির ছাদে দেখা যায়। সেখানে তাহমিদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। কথা বলার সময় তাদের প্রত্যেককে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। সিসিটিভি ফুটেজে এমন দৃশ্য দেখার পর জঙ্গি হামলার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত, ১ জুলাই গুলশানে স্প্যানিশ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে জঙ্গিরা। এতে ২০ জিম্মি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। এছাড়া পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এ নিহত হয় ৬ জঙ্গি। তারা হচ্ছে নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও শরীয়তপুরের সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। এছাড়া সন্দেহভাজন জঙ্গি জাকির হোসেন শাওন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জুলাই হাসপাতালে মারা যায়।