নতুন মোড়কে ৫৭ ধারা চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়
প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:১৬
বহুল বিতর্কিত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬’-এর ৫৭ ধারা নতুন মোড়কে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ২৯ জানুয়ারি (সোমবার) মন্ত্রীসভার বৈঠকে তোলা হবে। প্রস্তাবিত আইনে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ধারাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যে ধরনের ঘটনায় ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ চলছিল, সেগুলোকে ছাড় দেওয়া হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি কিছুটা কমানো হয়েছে। অপরাধের গুরুত্ব ও দণ্ডের মাত্রার ভিত্তিতে কয়েকটি ধারার অপরাধকে অজামিনযোগ্যও করা হচ্ছে। খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আগামীকাল সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে তোলা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদনের বিষয়টিও রয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী মন্ত্রিসভার জন্য পাঠানো সারসংক্ষেপে বলেছেন, ‘ধারা ৬২-এ এ আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ধারা ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ও ৬৬ বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।’ ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি আইন) ৫৭ ধারার আওতায় মামলা করে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে এ ধারা বাতিলের দাবিতে সাংবাদিকরা আন্দোলন করছেন, অন্যান্য মহল থেকেও এ দাবি তোলা হয়েছে। এ অবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ২২ জুলাই মন্ত্রিসভা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি নীতিগতভাবে অনুমোদন করে। খসড়ায় জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা—এসবে মদদ দেওয়ার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু যাবজ্জীবনের মতো কঠোর শাস্তির বিধান রাখায় সংশ্লিষ্ট সবাই একমত হতে পারেনি। সেই কঠোর অবস্থান থেকে এবার নমনীয় হলো সরকার। ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি ও কারাবিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ হচ্ছে ৩০ বছর কারাদণ্ড। এ অবস্থায় খসড়া আইনে অপরাধের শাস্তি কমিয়ে অনধিক ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত বিষয়গুলো একাধিক ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। চূড়ান্ত খসড়ায় একটিমাত্র ধারায় এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দেখা গেছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধগুলো ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কয়েকটি ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে নীতিগতভাবে অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ধারা ১৯-এ মানহানি, মিথ্যা ও অশ্লীল, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং ধারা ২০-এ শত্রুতা সৃষ্টি ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়েছিল। এসব বিষয় একই সঙ্গে দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৯ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ধারা ৫৭-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারা ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১-এ এসংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তিগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছে।
২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য প্রেরণ করেন, ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ করেন, মিথ্যা জানা থাকার পর কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, তাহলে এটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ অপরাধের শাস্তি হবে তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দান। এসব অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ২৮-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ করে, তাহলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড একসঙ্গে দেওয়া হবে।
২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে পেনাল কোডের সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ করেন, তাহলে তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। পেনাল কোডের সেকশন ৪৯৯-এ মানহানির কথা বলা হয়েছে। এ অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার বা বারবার এ অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। খসড়া আইনে এ ধারাটিকে অজামিনযোগ্য করা হয়েছে।
অপরাধের গুরুত্ব ও দণ্ডের মাত্রার ভিত্তিতে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪—এই ১৫টি ধারার অপরাধকে অজামিনযোগ্য করা হয়।
ভেটিং করার পরও ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আরো কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, আইনটি প্রয়োগনির্ভর (টেকনিক্যাল) হওয়ায় বিচারকাজ চলাকালে বিচারক প্রয়োজনীয় মনে করলে কোনো ডিজিটাল অপরাধের বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে পারবেন। এ ছাড়া মহাপরিচালকের ক্ষমতা অর্পণসংক্রান্ত একটি নতুন বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুফল ভোগের পাশাপাশি অপপ্রয়োগও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে সাইবার অপরাধের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও ডিজিটাল অপরাধগুলোর প্রতিকার, প্রতিরোধ, দমন, শনাক্তকরণ, তদন্ত এবং বিচারের উদ্দেশ্যে পৃথক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সাইবার তথা ডিজিটাল অপরাধের কবল থেকে রাষ্ট্র ও জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তাবিধানের জন্য এ আইন প্রণয়ন অপরিহার্য।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের আগে কয়েকটি দেশের নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করা হয়েছে। খসড়াটি সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজ্ঞ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কর্মকর্তা, আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যক্তিরা এবং স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে কয়েকটি সভা করে তাঁদের মতামত নিয়ে খসড়া করা হয়।
নীতিগতভাবে অনুমোদিত খসড়ায় সাতটি অধ্যায় এবং ৪৫টি ধারা ছিল। ভেটিং করা খসড়ায় ৯টি অধ্যায় এবং ৬৩টি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগে অনুমোদিত খসড়ায় ৩৭টি সংজ্ঞা ছিল। ভেটিংকৃত খসড়ায় ২১টি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্যবহার না থাকায় এবং আইসিটি আইনে ব্যাখ্যা থাকায় আইনানুগ প্রবেশাধিকার, বেআইনি, ই-প্রকিউরমেন্ট, ই-পেমেন্ট, উপাত্ত দূষণ, উপাত্ত, ডাটা, কনটেন্ট, ডিজিটাল বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, গ্রাহক তথ্য, ট্রাফিক ডাটা, ডিজিটাল পর্নোগ্রাফি, ডিজিটাল শিশু পর্নোগ্রাফি, ডিজিটাল তথ্যব্যবস্থা, ডিজিটাল যোগাযোগ, ডিজিটাল রেকর্ড, পাওয়ার্ড, বেআইনি প্রতিবন্ধকতা, বিচারক, শিশু—এসব বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ১২টি নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে আপিল ট্রাইব্যুনাল, ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম, উপাত্ত ভাণ্ডার, এজেন্সি, কম্পিউটার সিস্টেম, কাউন্সিল ও ডিজিটাল।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘(১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এ কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোন ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
সূত্র: কালেরকণ্ঠ