পরকীয়ার অপবাদে সালিসে দোররা, গৃহবধূর মৃত্যু
প্রকাশ | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:১৮
যৌতুকের জন্য বিয়ের পর থেকেই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সবার নির্যাতন সয়ে যাচ্ছিল মৌসুমী। সব নির্যাতনের পরেও স্বামীর ঘরকেই আপন ভেবে পড়েছিল সে। হয়তো ভেবেছিল কখনো সুখের দিন আসবে। কিন্তু সেই স্বামীর পরিবারের কারণেই যে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মৃত্যুকে আপন করে নিতে হবে তা হয়তো ভাবেনি মৌসুমী।
৯ মাস আগে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের আমগাঁও ইউনিয়নের খামার এলাকার মৃত হবিবর রহমানের ছোট মেয়ে মৌসুমীর বিয়ে হয় একই উপজেলার চৌরঙ্গী বাজার বালিয়াপুকুর গ্রামের মৃত সাদেকের বড় ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে জাহাঙ্গীরকে নগদ ৩০ হাজার টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই জাহাঙ্গীর মৌসুমীর পরিবারের কাছ থেকে আরো এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে। এ জন্য জাহাঙ্গীর প্রায়ই মৌসুমীকে নির্যাতন করে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত।
সর্বশেষ গত ২০ ডিসেম্বর রাতে বালিয়াপুকুর গ্রামে জাহাঙ্গীরের পরিবার মৌসুমীর বিরুদ্ধে পরকীয়ার অপবাদ দিয়ে মাতবরদের নিয়ে সালিশ ডাকে। সালিশে রায় হয়ে ১০১ বার দোররা মারা হয় মৌসুমীকে। এর মাঝে মৌসুমী কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে গেলেও জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আবার চলে নির্যাতন। নির্যাতনে জর্জরিত মৌসুমী পরদিন ২১ ডিসেম্বর মারা যান।
মৌসুমীর বড় ভাই জিন্নাত বলেন, গত ১৬ ডিসেম্বর এক লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে মৌসুমীকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় জাহাঙ্গীর। তখন মৌসুমী বাপের বাড়ি চলে আসেন। এরপর মৌসুমীর পরিবারের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরকে জানানো হয় যে ধীরে ধীরে তারা এই টাকা দেবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর পুরো টাকা একসঙ্গেই চাইছিল। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর কৌশলে মৌসুমীকে তার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সালিস বসায়।
সালিসে গ্রামের কাজি আবুল কালাম, আব্দুল কাদের, সাবেক ইউপি সদস্য জামালসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন বলে জিন্নাত জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সালিসের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ১১টায় জাহাঙ্গীরের বাসায় গ্রাম্য সালিস বসিয়ে কাজি আবুল কালামের নির্দেশে ‘ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক’ মৌসুমীকে তওবা পড়ানো হয়। এরপর ১০১ দোররা মারা হয়। তখন মৌসুমীর চিৎকারে তিনি ও আশপাশের অনেকে ছুটে আসেন ওই বাড়িতে। কিন্তু গ্রাম্য মাতব্বরদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে মৌসুমী বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরলে আবার দোররা মারা হয়। এরপর অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা বিনা চিকিৎসায় পরদিন মৌসুমী ওই বাড়িতেই মারা যান।
মৌসুমীর মৃত্যুর পর স্বামী জাহাঙ্গীর ও সালিসকারীসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজানা ১০ জনের নামে হরিপুর থানায় হত্যার অভিযোগ এনে এজাহার দেন তার স্বজনরা। তবে ২৭ ডিসেম্বর (বুধবার) বিকেল পর্যন্ত কোন হত্যা মামলা নেয়নি পুলিশ। বরং এটিকে অপমৃত্যু মামলা হিসেবে নিয়েছে তারা।
মৌসুমীর দুলাভাই আবেদ আলী বলেন, ঘটনা ধামাচাপা দিতে মৌসুমীর পরিবারকে জানানো হয় যে সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। অথচ যেদিন মৌসুমীর মৃত্যু হয় সেদিন স্থানীয় সারের ডিলার রফিকুলের দোকানে বৈঠক করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে পুলিশ বলছে, সালিসকারীদের অন্যতম কাজি আবুল কালামকে অপমৃত্যু মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযুক্ত বাকিরা পলাতক আছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, তাদের চাপে মৌসুমীর লাশের ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নিলেও পুলিশ প্রথমে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ২৩ ডিসেম্বর মৌসুমীর লাশের ময়নাতদন্ত হয়।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সুব্রত কুমার সেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনায় একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এই ব্যাপারে আমগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পাভেল ইসলাম বলেন, দেশে আইন-কানুন থাকতে এভাবে দোররা মেরে বিচার সালিস করা আইনত দণ্ডনীয়। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।