এক কিশোরের ধর্ষক ও খুনী হয়ে উঠার লোমহর্ষক গল্প
প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:০৬
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা কেরানীগঞ্জে সিরাজনগরে ফারজানা (৭) নামে এক শিশুকন্যা নিখোঁজ হয়। পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর চাচা রহমত আলীর বাড়ির পেছনে পাওয়া যায় তার হাত-পা বাঁধা লাশ। হত্যার দুই মাস পর উঠে এসেছে ধর্ষণের পর ফারজানাকে হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী।
নিহত শিশু ফারজানের বাবা কবির হোসেনের (৩৫) দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
যেদিন বিকেলে ফারজানা নিখোঁজ হয়, এর আগ মুহূর্তে সে তাদের বাড়ির পাশের রাস্তায় খেলছিল। আচমকা নিখোঁজ। কবির তখন মেয়ের খোঁজে মাইকিং করেন। কবিরসহ তার স্বজনেরা বাড়ির আশপাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু ফারজানাকে সেদিন আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরদিন সকাল ৬টার দিকে কবিরের মুঠোফোনে কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ফারজানা তাদের কাছে আছে। ৫ লাখ টাকা দিলে ফারজানাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বেলা ১টার মধ্যে টাকা নিয়ে বিমানবন্দরে আসতে হবে কবিরকে। কবির তখন কথিত অপহরণকারীদের বলেন, ফারজানা যে তাদের কাছে, এর প্রমাণ কী?
মুঠোফোনে কথা বলিয়ে দিতে বলেন কবির। তখন কথিত অপহরণকারীরা বলেন, ঘুমিয়ে আছে ফারজানা। এ জন্য কথা বলতে পারছে না। কথিত অপহরণকারীদের এই খবর কবির দিয়ে আসেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কাছে। বেলা ১টার দিকে কবিরের চাচা রহমত আলীর বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পাওয়া যায় ফারজানার লাশ।
দীর্ঘদিন ধরে কবিরের সঙ্গে চাচা রহমত ও তার সন্তানদের অনেক দিনের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। তারা তাকে সপরিবার হত্যা করার হুমকি দিয়ে আসছিলেন। তাই সন্দেহের তীর প্রথমে সেদিকেই ছোটে। তাই ফারজানাকে হত্যার অভিযোগ এনে চাচাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন কবির। সেখানে তিনি সুস্পষ্ট উল্লেখ করেন, এরাই তার মেয়েকে হত্যা করেছেন। সেদিন কবিরের চাচাত ভাই এনামুলসহ অন্যদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ড নিয়ে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু তারা খুন করার কথা অস্বীকার করেন।
হত্যার এজাহারভুক্ত আসামিদের অস্বীকারের মুখে ১৫ দিন পর মামলার তদন্তভার আসে ঢাকা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে। ডিবির কাছেও কবির একই অভিযোগ করেন। কিন্তু নিবিড় তদন্তে জেলা ডিবির এসআই মো. মনিরুজ্জামান দেখেন, ফারজানাকে খুন করেছেন অন্য আরেকজন।
তার তদারক কর্মকর্তা হলেন জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক (ওসি) দীপক কুমার সাহা।
দীপক কুমার বলেন, ফারজানাকে খুনের অভিযোগে পাঁচজন গ্রেপ্তার হলেও তারা যখন অস্বীকার করে আসছিলেন, তখন তারা নিবিড়ভাবে ঘটনার তদন্ত শুরু করেন। ফারজানার লাশ যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেই স্থান টানা তিন দিন পরিদর্শন করেন। ফারজানার বাবা কবিরের কাছ থেকে জানতে পারেন, মুক্তিপণের জন্য ৫ লাখ টাকা চেয়েছিল কথিত অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা। টুকে নেন সেই মুঠোফোন নম্বর। বের করেন মুঠোফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর)। দেখা যায়, কথিত অপহরণকারীরা কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে ফোন করেছেন।
কবিরের দেওয়া তথ্যমতে, কে বা কারা মুক্তিপণের টাকা চেয়েছিল কবিরের কাছে, এর রহস্য খুঁজতে শুরু করেন তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান, তদারক কর্মকর্তা দীপক কুমার। কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকেই মুক্তিপণের টাকা চাওয়া হয়েছে, এমনটা নিশ্চিত হয়ে আবার কবিরের বাড়িতে আসেন তারা। পরিবারের সদস্য, স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী সবার নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা দেখেন, কবিরের অন্য এক চাচার ছেলে বাড়িতে নেই। কবিরের ঘরের খুব কাছেই তাদের ঘর। কিন্তু সে তখন বাড়ি থেকে একটু দূরে সিরাজনগরে নানাবাড়িতে রয়েছে। সেখানে তাকে পাওয়া যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, ফারজানা মারা যাওয়ায় একা একা ঘরে থাকতে তার ভয় লাগে। এ জন্য সে সেখানে থাকে না। কবির এবং তদন্ত কর্মকর্তাকে একই কথা বলেন কিশোরের মা। আরো জানা যায়, ওই কিশোর পিইসি ও জেএসসিতে এ প্লাস পেয়ে সেখানকার একটি স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ে। বিজ্ঞান বিভাগের এই কিশোর এলাকায় মেধাবী ও ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া এই কিশোর ফারজানাকে খুব আদর করত। ফারজানা নিখোঁজ হওয়ার পর ওই কিশোর তাকে খুঁজতে বের হয়েছিল। সবার সামনে অনেক কান্নাকাটিও করেছে। মারা যাওয়ার পর বাড়িতেও সে ছিল।
দীপক কুমার বলেন, "কিশোর ও তার মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল তাকে ঘিরে? যে ছেলে সব সময় বাড়িতে থাকে, সে কেন হঠাৎ বাড়িছাড়া হলো? কৌশলে তাকে আমরা নজরদারি করতে থাকি। তার গতিবিধি অনুসরণ করা হয়। তার বন্ধুবান্ধব কারা, এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে থাকি। ছেলেটি অত্যন্ত মেধাবী ও চালাক। সুন্দর করে মিথ্যা কথা বলতে পারে। কিন্তু তার আচরণের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। সারাক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকত। একপর্যায়ে তাকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নিই। ৭ অক্টোবর গ্রেপ্তার করার পর ওই কিশোর ফারজানাকে খুন করার কথা অস্বীকার করে। জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে স্বীকার করে, ফারজানাকে সে মেরে ফেলতে চায়নি, অসাবধানতায় মারা গেছে। তার মুঠোফোনে অন্য সিম ভরে কবিরকে সেই ফোন দিয়ে মুক্তিপণের টাকা চেয়েছিল, যাতে সবাই ধারণা করে যে ফারজানাকে কোনো অপহরণকারী বা এমন একটি দল জিম্মি করেছে। ওই কিশোর পরে ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে"।
জবানবন্দিতে কিশোর বলে, "সেদিন আসরের নামাজের পর বাড়ির আশপাশে কেউ ছিল না। আমি তখন ফারজানাকে ডাকি। কাছে এলে আমি একহাত দিয়ে ফারজানার মুখ চেপে ধরি। তারপর আমি ফারজানাকে আমার পাশের কক্ষে নিয়ে যাই। ওই কক্ষে একটা স্কচটেপ ছিল, যা দিয়ে আমি ফারজানার মুখ বাঁধতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার অজান্তে ফারজানার মুখ নাকসহ বেঁধে ফেলি। এরপরও ফারজানা নড়াচড়া করছিল। তখন আমি রশি নেওয়ার জন্য একটু বাইরে আসি। আমি রশি নিয়ে ফিরে এসে দেখি, ফারজানা নড়াচড়া বন্ধ করে সোজা হয়ে শুয়ে আছে। তারপর আমি ফারজানার কাছে এসে কিছুক্ষণ তাকে খেয়াল করে দেখি, ফারজানা মরে গেছে। তারপর কিছুক্ষণ পর আমি ভাবছিলাম লাশটার কী করা যায়? লাশটাকে খাটের এক পাশে রেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বের হয়ে আসি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, লাশটাকে কী করব? তারপর সন্ধ্যার সময় যখন মাগরিবের আজান হচ্ছিল, তখন শুনি মাইকিং হচ্ছে যে ফারজানাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাইকিং শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। তারপর আমি সন্ধ্যার সময় বাড়িতে ফিরে এসে লোকজনের সঙ্গে ফারজানাকে খোঁজার ভান করি, যেন বাড়ির কেউ আমাকে সন্দেহ না করে। তারপর আমি আমার দরজা খুলে একটা পেপার দিয়ে লাশটাকে ঢেকে রাখি এবং কক্ষের জানালা খুলে রাখি। ওই কক্ষের জানালায় গ্রিল ছিল না। তারপর আমি দরজা দিয়ে বাইরে এসে ওই গ্রিলছাড়া জানালাটা দিয়ে রুমের ভেতর থেকে লাশ বের করে পাশের জঙ্গলে রেখে দিয়ে চলে আসি। তারপর আবার লোকজনের সঙ্গে ফারজানাকে খোঁজাখুঁজির কাজে লেগে যাই, যাতে কেউ আমাকে সন্দেহ না করতে পারে"।
তদন্ত তদারক কর্মকর্তা দীপক কুমার সাহা বললেন, "যখন কিশোর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তখনো হাতে পৌঁছায়নি। যখন হাতে আসে, তখন দেখি, সাত বছরের ফারজানাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ওই কিশোর তার জবানবন্দিতে ধর্ষণ করার কথা অস্বীকার করেছে"।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক হারুন অর রশীদ বলেন, "ফারজানাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। যৌনাঙ্গে রক্ত জমাটবাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়"।
নিহত ফারজানার বাবা কবির জানান, প্রায় সময় কিশোরের হাতে মুঠোফোন থাকত। কার সঙ্গে যেন কথা বলত। কারও সঙ্গে তেমন মিশত না। তার মুঠোফোনটি বেশ দামি ছিল।
ফারজানার বাবা কবির বলেন, ‘আমার মেয়েকে যে খুন করেছে, তার ফাঁসি চাই। ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি চাই না।’
এদিকে দীপক কুমারের ধারণা, কিশোরটি মুঠোফোনের মাধ্যমে নিয়মিত এমন কিছু দেখত, যা তার মধ্যে যৌন–আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। আর আকাঙ্ক্ষা মেটাতেই শিশুটিকে ধর্ষণ করে থাকতে পারে। কিশোরটি তার অপরাধ ধামাচাপা দিতেই শিশুটিকে হত্যা করে থাকতে পারে।
দীপক কুমার বলেন, কিশোর তাদের বলেছে যে মুঠোফোনটি সে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। খুব শিগগিরই তার বিরুদ্ধে ফারজানাকে হত্যার অভিযোগে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। অন্যদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হবে। গ্রেপ্তার করা আসামিরা এখন জামিনে আছেন।
ফারজানা খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ঐ কিশোর এখন সংশোধন কেন্দ্রে আছে।