বাংলাদেশের ২৪ স্থানে হামলা চালাবে জঙ্গিরা
প্রকাশ | ১১ জুলাই ২০১৬, ১৭:০৭
সন্ত্রাস কৌশলের যে চিরাচরিত ছকের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন ভারত-বাংলাদেশের গোয়েন্দারা, গুলশান কাফে সেই ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। গুলশানের তদন্তে যে সব তথ্য উঠে আসছে, তাতে স্পষ্ট, এখনই সামাল দেওয়া না গেলে আগামী দিনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করে আছে। গত এক সপ্তাহ ধরে তদন্ত চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ঢাকা-সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় নানা মাপের হামলা চালানোর জন্য জঙ্গিদের একটি বড়সড় রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি হয়ে রয়েছে রাজধানীর ১৫ কিলোমিটার বৃত্তের মধ্যে! আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের কমপক্ষে ২৪টি স্থানে জঙ্গিরা হামলা চালাবে বলে জানা গেছে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, যে কোনও সময় হামলার জন্য তৈরি এই জঙ্গিরা প্রত্যেকেই বয়সে তরুণ, উচ্চশিক্ষিত, কম্পিউটারে পারদর্শী এবং একই সঙ্গে সমাজের উপর তলার প্রতিনিধি। গুলশান হামলার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এক জন বাদে বাকি জঙ্গিরা সকলেই উচ্চশিক্ষিত ছিল। একই ভাবে বুধবার যে তিন সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গি এক ভিডিও-বার্তায় বাংলাদেশে আরও বড় একাধিক হামলার হুমকি দিয়েছে, তারাও যথেষ্ট শিক্ষিত এবং সমাজে পরিচিত বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা।
বৃহস্পতিবার ঈদের সকালে ঢাকা-লাগোয়া কিশোরগঞ্জে হামলা এই রিজার্ভ বেঞ্চের একাংশই চালিয়েছে কি না, তা রাত পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি। তবে সে আশঙ্কা উড়িয়েও দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা।
বুধবার বাংলাদেশে ফের হামলা চালানোর হুমকি দেওয়া যে ভিডিওটি সামনে এসেছে, গুলশান এবং কিশোরগঞ্জে হামলা নিয়ে তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
ভিডিওতে যে তিন যুবককে দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশ প্রশাসন সূত্রের খবর, তাদের প্রথম জন তুষার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রয়াত মেজর ওয়াশিকুর আজাদের ছেলে। পেশায় দাঁতের ডাক্তার। বারিধারার বাসিন্দা এই তুষার ২০১১ সালে বিয়ে করে পরিচিত মডেল লায়লা নাইমকে। অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় জন, তৌফিক হুসেন এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ছাত্র ছিল। তবে পড়াশোনা শেষ করেনি। জেএমবি-যোগের অভিযোগে পুলিশ একবার তাকে গ্রেফতারও করে। তৃতীয় জনের পরিচয় জেনেও চমকে উঠছেন গোয়েন্দারা। বাংলাদেশের প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমানের ছেলে তাহমিদ রহমান সাফি একটি টিভি-শো-র দৌলতে পরিচিত গায়ক। এমবিএ পাশ তাহমিদ গ্রামীণ ফোনে চাকরি করত। ২০১১ সালের পর সেখান থেকে ইস্তফা দেয়। একটি সূত্রের দাবি, কয়েক বছর আগে তাহমিদ স্ত্রী-কে নিয়ে আইএস-এর শক্ত ঘাঁটি সিরিয়ায় পাড়ি দেয়।
গুলশানের হামলাকারী এবং আইএস-ভিডিওয় হুমকি দেওয়া যুবকদের পরিচয় স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, কী ভাবে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের একাংশকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে গোটা বাংলাদেশকে কার্যত বারুদের স্তূপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, সুপরিকল্পিত ভাবে এই কাজ করতে গিয়ে আইএস সাহায্য নিয়েছে আনসারুল্লা বাংলা টিম (এবিটি)-এর। গোয়েন্দারা বলছেন, আইএসের এখন লক্ষ্যই হল শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়। যাদের এক নজরে মোল্লাতন্ত্রের প্রতিনিধি বলে মনে হবে না। ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা এই উচ্চশিক্ষিত যুবকদের
খালি চোখে সন্দেহ করা কঠিন। সাধারণত মাদ্রাসা শিক্ষিত এবং নিম্নবর্গীয়রাই জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে বলে একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে গোয়েন্দাদেরও। এদের চিহ্নিত করাও সহজ। তাই কৌশল পাল্টে এখন শিক্ষিত যুবকদের দলে টানছে আইএস। এবিটি বেশ কিছু দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার শিক্ষিত যুবকদের একাংশকে জিহাদের তালিম দিচ্ছে। উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতে মৌলবাদকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া।
স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের সন্ত্রাস-ছবি চিন্তার ভাঁজ ফেলছে সব পক্ষের কপালে। এখনই রাশ টানা না গেলে আগামী দিনে যে আরও বড় বিপদ আছড়ে পড়বে, তা বিলক্ষণ বুঝছেন সকলেই। আফ্রিকা সফররত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ দিন মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পরে সে কথাটাই মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসই এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিপদ।
এই পরিস্থিতিতে আজ ভারত থেকে এনএসজি-র চার সদস্য ঢাকা গিয়েছেন। গুলশান কাণ্ডে কী ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল, তা দেখবে ওই দলটি। পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হবে ওই দেশে ভারতীয় হাইকমিশন-সহ অন্য ভারতীয় ভবনের সুরক্ষার বিষয়টিও।
গুলশান-কিশোরগঞ্জের মতো হামলা যে অদূর ভবিষ্যতে আরও ঘটতে চলেছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রশাসনকে ফের সতর্ক করেছে নয়াদিল্লি। ভারত জানিয়েছে, ঢাকার মতো বড় শহর ছাড়াও কিশোরগঞ্জ মডেলে ছোট ছোট জমায়েতে হামলা চালিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবে জঙ্গিরা। সম্প্রীতি নষ্ট করতে হামলা চালানো হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরেও। ভারত-বাংলাদেশ জঙ্গি দমন সমন্বয়কে অকেজো করে দেওয়াটাও লক্ষ্য।
গুলশান কাণ্ডের আগে থেকেই বাংলাদেশে ধরপাকড় চালু রয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, পরিকল্পিত ভাবে জেলগুলিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হবে। এমনকী টালমাটালের সুযোগে জামাতপন্থী নেতাদের জেল ভেঙে বের করে নিয়ে যাওয়ার ছক কষাও হচ্ছে। বর্তমানে জেলে রয়েছে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলি, যার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয়ে রয়েছে। মিডিয়া টাইকুন কাসেম আলিকে ছাড়াতে পাকিস্তানও প্রবল সক্রিয়। গোয়েন্দাদের একাংশের ধারণা, গুলশান-কিশোরগঞ্জের মতো ঘটনা ঘটিয়ে দেশে অস্থিরতা তৈরি করে এই ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়ারও কৌশল রয়েছে।
গুলশান কাণ্ডের তদন্তে আমেরিকার পাশাপাশি জাপানও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে ভারতের সঙ্গে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে খবর, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে জাপান সন্ত্রাস প্রশ্নে গয়ংগচ্ছ মনোভাব নিয়েই চলছিল। কিন্তু গুলশান কাণ্ডে ৭ জাপানি নাগরিক হত্যার পর প্রবল আতঙ্কে টোকিও। গত বছর জাপানের সঙ্গে ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী মেকানিজমের কথা হয়। কিন্তু তা বিশেষ এগোয়নি। এ বারে সেই মেকানিজমকে কার্যকরীর জন্য ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে জাপান।
সূত্র: আনন্দবাজার