কক্সবাজারে ক্যাম্প ছেড়ে শহরে ঢুকছে রোহিঙ্গা
প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:৪২
কক্সবাজার শহরের পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা। উখিয়া-টেকনাফের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে হঠাৎ শহরের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে স্রোতের মত আসতে শুরু করে। এতে নিরাপত্তা নিয়ে স্থানীয়রাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গার ঢল নামে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সীমান্ত এলাকায়। চাপ বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা দালাল অথবা আগে থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে বসবাস করা আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে কক্সবাজার শহরসহ পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি চট্টগ্রামের দিকেও চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
৪ সেপ্টেম্বর (সোমবার) থেকে শহরের পাহাড়তলী, বৈদ্যেরঘোনা, ঘোনারপাড়া, খাঁজামঞ্জিল, লাইটহাউজ, রুমালিয়ারছড়া, সাহিত্যিকাপল্লী, বিজিবি ক্যাম্প এলাকা, কলাতলী আদর্শগ্রাম, সমিতিপাড়া, চন্দ্রিমা সমিতি এলাকা, নতুন জেলগেইট এলাকাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় স্রোতের মত ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। তারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকায় আগে থেকে পালিয়ে আসা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ও ভাড়া বাসা নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
৯ সেপ্টেম্বর (শনিবার) দুপুরে শহরের পাহাড়তলী জিয়ানগর এলাকায় গিয়ে দেখা মিলে নতুন পালিয়ে আসা শতাধিক রোহিঙ্গার। সেখানে কয়েকটি বাড়িতে রোহিঙ্গাদের প্রচণ্ড ভীড় দেখা যায়। হৈচৈ শুরু হয়েছে বাড়িগুলোতে। নারী পুরুষেরা বাড়িতে বসে আছে। শিশুরা পাহাড়ের ঢালুতে বসে দিকবিদিক ছুটাছুটি করছে।
পাহাড়তলী জিয়ানগরে পাহাড় কেটে বাড়ি তৈরী করে বসবাস করেন দীল মোহাম্মদ (৪২)। তিনিও রোহিঙ্গা। গত পাঁচ বছর আগে তিনি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে পরিবার নিয়ে ওই এলাকায় বসবাস করছে। তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে নারী-পুরুষ, শিশুসহ ২০ জন রোহিঙ্গা। তারা সবাই তার স্ত্রীর আত্মীয় স্বজন। ওই বাড়িতে স্ত্রী সন্তান ও নাতি নাতনী নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মো. হোছন (৫৫)। তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডু ধাওনখালী গ্রামে।
তিনি বলেন, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমার মিলিটারি হঠাৎ গ্রামে এসে নির্বিচারে গুলি চালায়। গত ২৮ আগস্ট ফের মিলিটারিরা এসে তার ভাইয়ের ছেলে ওসমান গণি (২৬) ও ওমর ফারুককে (২৩) বাড়ির উঠোনে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে পাহাড় পথ দিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এসে অবস্থান নেয়। গত ৪ সেপ্টেম্বর (সোমবার) নৌকা নিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় চলে আসে। আসার সময় ওই মাছ ধরার নৌকার মাঝি তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে আদায় করে। তাদের হাতে টাকা না থাকায় স্বর্ণলঙ্কার দিয়ে ভাড়া পরিশোধ করে। পরে লেদা ক্যাম্পে একদিন থাকার পর গত ৬ সেপ্টেম্বর (বুধবার) সেখান থেকে তার স্ত্রীর বোনের স্বামী দিল মোহাম্মদ তাদেরকে কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী জিয়ানগর নিয়ে আসে।
তিনি আরো বলেন, দিল মোহাম্মদ কয়েকবছর আগে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। তারা পুরুষ রয়েছেন চারজন। বাকিরা শিশু ও নারী। কয়েকদিন পর শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে। দিল মোহাম্মদের পাশেই ভাড়া বাসা নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
দিল মোহাম্মদ জানান, অসহায় হিসাবে তাদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের জন্য থাকা ও কাজের ব্যবস্থা করছেন তিনি।
তিনি আরো জানান, জিয়ানগর এলাকা তার বাড়ি ছাড়াও বোরহান, হাবিবুর রহমান, আব্দুর রব, জসিম উদ্দিন, আবু জমিরসহ প্রায় ১১টি বাড়িতে প্রায় ২’শ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। এসব বাড়ির মালিকেরাও বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে জিয়ানগরে বসবাস করছে।
জিয়ানগরে আব্দুর রবের বাড়িতে ৬ সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন জাহেদা বেগম (৩৯)। তার স্বামী কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে সহায়তার জন্য অপেক্ষা করছেন। মিয়ানমারে তাদের বাড়ি মংডু মেরুল্লা পশ্চিম পাড়া গ্রামে।
তিনি বলেন, গত ৫ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) নৌকা ভাড়া দিয়ে টেকনাফের শাপলাপুর এলাকায় উঠে। এরপর তার স্বামী কয়েকজন লোকের সাথে কুতুপালং শিবিরে চলে যায়। আর অন্যান্য নারীদের সাথে তিনি গত ৬ সেপ্টেম্বর (বুধবার) শহরের পাহাড়তলী জিয়ানগরে এসে আব্দুর রবের ভাড়া বাসায় উঠে। পাহাড়তলীতে তাদেরকে নিয়ে আসেন টেকনাফের শাপলাপুর এলাকার জনৈক আব্দুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি।
তিনি আরো বলেন, তার কাছে কিছু টাকা ছিল সেগুলো দিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন তিনি। এখন টাকা পয়সা কিছুই নেই। গত ৬ সেপ্টেম্বর (বুধবার) রাত থেকে তারা কিছুই খাননি বলে জানান।
জিয়ানগরের পাশে বৈদ্যঘোনা খাজা মঞ্চিল পাহাড়েও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
সেখান থেকে পাহাড়তলী লাইট হাউজ সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে রাস্তায় দেখা মিলে একটি ছারপোকা গাড়ির। ওই গাড়িতে করে এসেছেন নতুন ২০ জন রোহিঙ্গা। তারা উঠেছেন লাইটহাউজ ফাতেরঘোনা মৌলভী ওসমান গণি নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে। তিনিও আগে থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা বহনকারি ওই গাড়ির চালক মো. আরিফ বলেন, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শাপলাপুর এলাকা থেকে ওসব রোহিঙ্গাদের বিজিবি সদস্যরা তার গাড়িতে তুলে দেন। মৌলভী ওসমান গণির সাথে রোহিঙ্গা যাত্রীরা মোবাইলে যোগাযোগ করে। লাইটহাউজ পৌঁছে গাড়ি ভাড়া দেন মৌলভী ওসমান গণির স্ত্রী। ওসমান গণির সাথে কথা বলার জন্য তার বাড়িতে গেলে তিনি বাড়িতে নেই বলে দাবি করেন এক নারী। তারা কেউ কথা বলতে চাননি।
লাইটহাউজ ফাতের ঘোনা এলাকায় গত ৬ সেপ্টেম্বর (বুধবার) থেকে ৭ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) বিকাল তিনটা পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। ফাতেরঘোনা এলাকায় আগে থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আত্মীয় স্বজনেরা বসবাস করছেন। বেশির ভাগই আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে উঠেছেন।
লাইটহাউজ ফাতের সমাজ কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, দুইদিন থেকে রোহিঙ্গা আসা শুরু করেছে। তারা এখানে আত্মীয় স্বজনের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ জনের মত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তার এলাকায়। নতুন এসব রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই খারাপ। অনাহারে দিনাতিপাত করছে তারা। তাদের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, ফাতেরঘোনা এলাকায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে জুবায়ের আহমেদ, কামাল উদ্দিন ও মৌলভী ওসমান গণি। তারাও বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে ফাতেরঘোনা এলাকায় বসবাস করছে। তাদের বাড়ি ছাড়াও আশপাশের ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। এছাড়াও পাশ্ববর্তী পাহাড়তলী সাত্তারঘোনা এলাকায় রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। সেখানে তিনদিনে অন্তত তিনশতাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বুধবার থেকে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শহরে প্রবেশ করেছে। তারা শহরের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।