রোহিঙ্গা সংকট

নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক ডেকেছে ৭ দেশ

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:৫৩

জাগরণীয়া ডেস্ক

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ফের বৈঠকে মিলিত হচ্ছে জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদ। আগামী সপ্তাহে এ বৈঠক হতে যাচ্ছে। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো মিলিত হচ্ছে সংস্থার ১৫ সদস্য। বৈঠক আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এবারের বৈঠকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরও কঠোর চাপ আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কারণে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকায় এখন সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার কিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখিয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং টুন গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকে এই প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই বলেছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হলে নতুনদের পাশাপাশি আগে থেকে আশ্রয় নেওয়াদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কথা বলতে হবে।

আন্তর্জাতিক চাপের কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ করার কথা বলছেন অং সান সু চি। ২২ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) সু চির ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যের পরামর্শ বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কক্সবাজারের মানবিক সহায়তায় যুক্ত সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৫ আগস্ট থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান
রাখাইনে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল ১৩ সেপ্টেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছিল। বিবৃতিতে রাখাইনের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়। জাতিসংঘে যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের স্থায়ী প্রতিনিধিদের উদ্যোগে নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর ওই বিবৃতি আসে। যদিও বিবৃতিটি দুর্বল বলে সমালোচনা উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার বাধার মুখে পড়তে পারে—এটি বিবেচনায় নিয়ে বিবিধ প্রসঙ্গে তা আলোচনায় তোলা হয়। ওই বিবৃতি ছাড়াও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আলোচনার ফাঁকে ১৯ সেপ্টেম্বর বিশেষ সভা ডাকে যুক্তরাজ্য।

নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রও সমস্যার সমাধানে সক্রিয় রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন এ নিয়ে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। একই বিষয়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন সেনাপ্রধানের ফোনে কথা হয়েছে। সর্বশেষ সমস্যাটি নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফি গত সপ্তাহে নেপিডোতে যান।

নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতাকে ‘জাতিগত নিধনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ’ বলেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। এই অভিযোগে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাউন্সিল ব্যবস্থা নিতে বলেছে। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ রাখাইনের সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ বলেছেন। সব মিলিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যরাষ্ট্রের তিনটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জোরালো অবস্থান নিয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আগামী সপ্তাহে প্রকাশ্য আলোচনা ডাকবেন। ওই আলোচনায় পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেবেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশের এক কূটনীতিক শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নয় এমন কোনো দেশের বিষয়ে আলোচনা করতে হলে স্থায়ী সব সদস্যকে একমত হতে হয়। এই মুহূর্তে মিয়ানমার নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা তীব্র হচ্ছে। তা ছাড়া স্থায়ী ৫ ও অস্থায়ী ১০ সদস্যের মধ্যে ৭ সদস্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমার বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাবে বাধা আসার সম্ভাবনা কম। ফলে আগামী সোম থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের সাত সদস্যের উদ্যোগটি অবশ্যই ভালো এবং ইতিবাচক। তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো বিবৃতি কিংবা বাধ্যতামূলক কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার সমর্থন প্রয়োজন, যারা এখনো আমাদের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। তাই আমাদের উচিত হবে দুই দেশের সঙ্গে সক্রিয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে সংবেদনশীল করা।’

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে গত শুক্রবার দুপুরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে। এ ছাড়া পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি থেকেও ধোঁয়া উড়েছে। নতুন ভিডিও চিত্র আর স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে।

উত্তর রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল জনতা আগুন লাগিয়েছে।

অ্যামনেস্টির ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান বলেন, ‘রাখাইনে সেনাবাহিনীর “শুদ্ধি অভিযান” ৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে বলে অং সান সু চি বিশ্বের কাছে দাবি করলেন। কিন্তু ভূমি আর মহাশূন্য থেকে অপরাধের এই প্রমাণ পাওয়া গেল। তিন সপ্তাহ পরও উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার তীব্রতা কমার কোনো লক্ষণ দেখছি না। আতঙ্কে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের বাড়িঘর পোড়ানো শুরু হয়।’ তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই অভিন্ন কণ্ঠে মিয়ানমারকে নিন্দা জানাতে হবে এবং জাতিগত নিধনের প্রচারণা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

মংডুর পার ওয়াট চং গ্রামের কাছে ২১ সেপ্টেম্বর ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা গেছে, চারপাশে গাছপালা ছড়ানো বসতিতে ধোঁয়া উড়ছে। স্থানীয় এক অধিবাসী অ্যামনেস্টিকে বলেন, মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল জনতা ওই দিন দুপুরের আগে আগুন লাগায়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পার ওয়াট চংয়ের ১৬ থেকে ২২ সেপ্টেম্বরের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছে, পুড়ে যাওয়া গ্রামের কাঠামোগুলোতে কয়েক দিন আগে আগুন দেওয়া হয়েছে। বুথিডংয়ের গা ইয়ান্ত চং গ্রামের ধারণকৃত ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা দেড়টা থেকে আড়াইটার মধ্যে সেখানে আগুন দেওয়া হয়।

এর আগে অ্যামনেস্টি স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে রাখাইনে ব্যাপক আকারে ‘পোড়ামাটি নীতি’ প্রয়োগের অভিযোগ এনেছিল। রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল জনতা রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় ওই সব লোকের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ওই সহিংসতা ২৫ আগস্ট তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর সমন্বিত হামলার জবাবে বেআইনি ও মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অংশ।

সন্ত্রাসীদের তালিকা দেবে মিয়ানমার
বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ও জাতিসংঘের কাছে রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের তালিকা দেবে মিয়ানমার। অং সান সু চির দপ্তরের বরাত দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মুখপত্র ইলেভেন মিয়ানমার গত শুক্রবার এ খবর জানায়। রাখাইন রাজ্যবিষয়ক কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য গঠিত কমিটির সঙ্গে বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

মিয়ানমার সরকারের নিন্দায় সৌদি আরব
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নমূলক নীতি গ্রহণ করায় গতকাল শনিবার দেশটির সরকারের নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গতকাল দেওয়া ভাষণে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার যে দমননীতি চালাচ্ছে, সে বিষয়ে আমার দেশ খুব ভালোভাবে অবগত আছে। আমরা মিয়ানমার সরকারের ওই নীতির তীব্র নিন্দা জানাই।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত